×

রাজপথে ইশরাকের ১৬ দিন, শেষ হাসি কার

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) মেয়র পদ নিয়ে গত কয়েক মাসে জটিল হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ও আইনি পরিস্থিতি। ২০২০ সালের ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনের পাঁচ বছর পর আদালতের রায় অনুযায়ী বিএনপির ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে বৈধ মেয়র ঘোষণা করা হলেও এখনো তিনি শপথ নিতে পারেননি। এরপর থেকে নগর ভবনের সামনে টানা ১৬ দিনের আন্দোলন এবং নানা আইনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে চলমান এই সংকট নতুন মাত্রা পেয়েছে। রাজনীতির অমীমাংসিত অধ্যায়ের বিস্তারিত ময়নাতদন্ত করেছেন মো. ইসতিয়াক

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে বিএনপির নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের শপথ গ্রহণ ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে এক জটিল আইনি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি।

আদালতের পর্যবেক্ষণে বিষয়টি এখন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে। এদিকে নগর ভবনে টানা ১৬ দিন ধরে অবস্থান করছেন ইশরাকের সমর্থক-কর্মীরা। তাঁদের দাবি একটাই,‘জনতার রায়ে নির্বাচিত মেয়রের শপথ নিতে দিতে হবে।’
আন্দোলনে নগর সেবা বন্ধ থাকায় সেবা গ্রহণ করতে আসা নগরবাসী ও কর্মচারীরা, দুই দলই আছেন অস্বস্তিতে।

হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ, আপিল বিভাগে নাটকীয় মোড়
ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করা নিয়ে ২০২৫ সালের ২২ মে ঢাকা নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মামুনুর রশিদ হাইকোর্টে রিট করেন। তিনি যুক্তি দেন, ওই রায় কার্যকর হলে ঢাকা শহরের প্রশাসন অচলাবস্থায় পড়বে এবং তা সাংবিধানিক অচলাবস্থা সৃষ্টি করবে। কিন্তু হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ, বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরী ২২ মে এই রিট আবেদন খারিজ করেন। তাঁরা বলেন, মামুনুর রশিদ নিজে নির্বাচনের পক্ষভুক্ত ব্যক্তি নন। তাই রিট দায়েরের এখতিয়ার তার নেই।
এরপর ২৭ মে মামুনুর রশিদ আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে লিভ টু আপিলের আবেদন করেন। শুনানি শেষে ২৮ মে চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন।
২৯ মে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দেন,ইশরাক হোসেনের শপথ গ্রহণ এবং মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের। আদালত স্পষ্ট করেন, এ বিষয়ে কোনো স্থগিতাদেশ বা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি।
ইশরাক হোসেনের আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন সাংবাদিকদের বলেন, ‘তাঁরা গেজেট স্থগিত চেয়েছিল। কিন্তু আপিল বিভাগ তা স্থগিত করেনি। আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তাই তাঁরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তাঁদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে।’

এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন আরও জানান, ‘ইসি পক্ষ না হওয়ায় এবং আপিল করার যুক্তি না থাকা তাঁরা আপিল করবে না বলে আগেই জানিয়েছিলেন। আজকে (২৯ মে) যে আদেশ হয়েছে, তাতে আবেদনকারীকে লিভ দেওয়া হয়নি। কোনো স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়নি এবং বিষয় নিষ্পত্তি করা হয়েছে। আদালত বলেছেন, ইসির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’

নগর ভবনে টানা ১৬ দিনের আন্দোলন: ছাতা হাতে শহরবাসী
২০২৫ সালের ১৪ মে থেকে শুরু হয় গুলিস্তানে নগর ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি। ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে স্থানীয় জনতা, করপোরেশনের কর্মচারী, ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক থেকে শুরু করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর কর্মীরা অংশ নেন এই অবস্থান কর্মসূচিতে।
এ সময় বিভিন্ন স্লোগানে তাঁরা নিজেদের দাবি তুলে ধরেন। কর্মসূচির প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণ থাকলেও গত ২৪ মে থেকে আন্দোলনে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। মেয়রের চেয়ারে গামছা পেতে প্রতীকী মেয়র বসানো হয়। কয়েকজন আন্দোলনকারী প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সেই চেয়ারে বসে থাকেন প্রতীকী মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকরেন।

ইশরাকের কণ্ঠে আক্ষেপ ও চ্যালেঞ্জ
২৯ মে (বৃহস্পতিবার) বিকেলে নগর ভবনের সামনে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন ইশরাক হোসেন। তিনি বলেন,‘আমি পাঁচ বছর ধরে আইনের পথে হেঁটেছি। আদালত আমার পক্ষে রায় দিয়েছে। তারপরও আমাকে শপথ নিতে দেওয়া হচ্ছে না। এটি জনগণের রায়ের অবমাননা।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারকে শেষবারের মতো সুযোগ দিচ্ছি,জনগণের রায় মানুন। নয়তো ঢাকাবাসী রাজপথে সিদ্ধান্ত জানাবে।একজন মেয়রকে শপথ করাতে ব্যর্থ যারা, তারা জাতিকে কীভাবে চালাবে?’

কার্যত অচল সিটি করপোরেশন
নগর ভবনে কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকলেও অনেক কাজ রয়েছে বন্ধ। ব্যবসায়ীরা ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে পারছেন না, বাস মালিকরা নতুন রুট পারমিট পাচ্ছেন না।আবার মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম, আবর্জনা সংগ্রহ, অবৈধ দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম সবই অচল হয়ে আছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা দক্ষিণের নাগরিক পরিষেবা পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়েছে। দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান না হলে বাণিজ্যে ধস নামবে।’

নির্বাচন কমিশন যা করছে
গেজেট প্রকাশের এক মাস পরও নির্বাচন কমিশন এখনো ইশরাক হোসেনকে শপথের সময় ও স্থান জানায়নি। কমিশন সচিবালয় বলছে, ‘আদালতের পর্যবেক্ষণ ও আইনি মতামতের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

রাজনৈতিক ও আইনি প্রশ্ন
এই সংকট সামনে নিয়ে এসেছে বেশ কিছু মৌলিক রাজনৈতিক ও আইনগত প্রশ্ন।যেমন সুপ্রিম কোর্টের বিএনপিপন্থী সিনিয়র আইনজীবী মোনাকেব বাহার বলেন, ‘একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির শপথ গ্রহণে বাধা দেওয়া সংবিধানের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও জনগণের ভোটের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা উচিত। রাজপথের গণআন্দোলনও এই প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংকেত যা আদালত ও নির্বাচন কমিশন উভয়কেই বিবেচনায় নিতে হবে।’ তবে অন্য কয়েকজন আইনজীবি বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

২০২০ সালের শুরু এবং২০২৫ সালের বিস্ফোরণ
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এতে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন ইশরাক হোসেন। আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। নির্বাচনের ফলাফলে তাপস বিপুল ভোটে জয়ী হন। ২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করে। ১৬ ফেব্রুয়ারি তাপস শপথ গ্রহণ করেন।
তবে বিএনপির অভিযোগ ছিল, নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, ভোটারদের ভয়ভীতি ও ইভিএম জালিয়াতির মাধ্যমে ফলাফলকে প্রভাবিত করা হয়েছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২০ সালের ৩ মার্চ ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করেন ইশরাক হোসেন।
নানা আইনি জটিলতায় এই মামলা পাঁচ বছর স্থগিত ছিল। এরপর ২৪ এর গণ অভুথ্যানের পরে চলতি বছরের ২৭ মার্চ নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল রায় দেন, শেখ ফজলে নূর তাপসকে নির্বাচিত ঘোষণা করাই ছিল বেআইনি এবং ইশরাক হোসেনই বৈধ মেয়র। নির্বাচন কমিশন ২৭ এপ্রিল সেই রায়ের ভিত্তিতে গেজেট প্রকাশ করে।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment