ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের মৃত্যুদণ্ড বহাল: সিনহা হত্যা নিয়ে যা হলো
স্ট্রিম ডেস্ক
প্রায় পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের মামলায় অবশেষে চূড়ান্ত রায় দিয়েছেন দেশের উচ্চ আদালত। বহুল আলোচিত এই মামলায় হাইকোর্টের রায়ে টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ এবং বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন ইনচার্জ পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন। একইসঙ্গে মামলার ছয় আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও বহাল রাখা হয়েছে।
রায় অনুযায়ী প্রত্যেক আসামিকে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে । এ ছাড়া জরিমানা অনাদায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের ভোগ করতে হবে আরও ছয় মাস করে অতিরিক্ত কারাদণ্ড।
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন সাবেক এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল রুবেল শর্মা, এএসআই সাগর দেব এবং কক্সবাজারের বাহারছড়ার মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আইয়াজ ও মো. নিজাম উদ্দিন।
আজ সোমবার (২ জুন) বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি মো. সগীর হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।
মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের ওপর একসঙ্গে শুনানি নিয়ে এই রায় দেওয়া হয়। রায়ের শুনানি শুরু হয় ২০২৫ সালের ২৩ এপ্রিল এবং তা শেষ হয় ২৯ মে। এরপর আদালত ২ জুন রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করেন।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জসীম সরকার ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল লাবনী আক্তার। আসামিপক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী, এস এম শাহাজাহান, শেখ মো. জাহাঙ্গীর আলম ও শফিকুল ইসলাম রিপন।
ন্যায়বিচারের পথে আরেক ধাপ
২০২০ সালের ৩১ জুলাই। কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশিচৌকি। রাত সাড়ে ৯টার দিকে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান গুলিবিদ্ধ হন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর।
সিনহা তখন ভ্রমণবিষয়ক একটি তথ্যচিত্র তৈরির কাজে কক্সবাজারে ছিলেন। পাহাড়ে ভিডিও ধারণ শেষে ঢাকায় ফিরছিলেন তিনি। তাঁর গাড়িতে ছিলেন সঙ্গী সিফাত।
এই হত্যাকাণ্ডের পরদিনই সিনহার বোন তানিয়া খান বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় মোট ১৫ জনকে আসামি করা হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সাবেক ওসি প্রদীপ, ইনচার্জ লিয়াকত এবং পুলিশের তিন সদস্য ও তিন সোর্স।
২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল মামলার রায় দেন। প্রদীপ ও লিয়াকতের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয় ওই রায়ে। অন্য ছয়জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে বাকি সাত আসামিকে খালাস দেন বিচারক।
বিচারিক আদালতের এই রায় পরে অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে পাঠানো হয় ডেথ রেফারেন্স হিসেবে। একই সঙ্গে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা পৃথকভাবে আপিল করেন। পরে দুটি প্রক্রিয়াকে একসঙ্গে শুনানি শেষে হাইকোর্ট আজ রায় ঘোষণা করেছেন।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে জনমতের চাপ
এই রায় ঘোষণার আগেই দেশজুড়ে উচ্চ পর্যায়ের উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক সদস্যদের সংগঠন ‘এক্স-ফোর্সেস অ্যাসোসিয়েশন’ শুরু থেকেই দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানিয়ে এসেছে। গত ২৬ এপ্রিল ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি দ্রুত শেষ করে সাত কার্যদিবসের মধ্যে রায় কার্যকর করতে হবে।
কোনো রাজনৈতিক চাপ কিংবা ভয়ভীতি যেন রায় কার্যকরে প্রভাব ফেলতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক করেন সংগঠনের আহ্বায়ক অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, ‘রায় কার্যকরের মাধ্যমে আমরা জাতিকে বার্তা দিতে চাই, অপরাধী যে-ই হোক, আইনের হাত থেকে কেউ রেহাই পাবে না।’
সংগঠনের সদস্যসচিব লেফটেন্যান্ট (অব.) সাইফুল্লাহ খান সাইফ আদালতের প্রতি অনুরোধ করেন, মামলার শুনানি যেন আর দীর্ঘায়িত না হয়। এ ছাড়া ন্যায়বিচার পেতে আর দেরি করা ঠিক হবে না বলেও মনে করেন তিনি।
রায় দ্রুত কার্যকর না হলে তাঁরা কঠোর কর্মসূচির হুশিয়ারিও দেন। এর পাশাপাশি তাঁরা রায়ের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর আস্থা প্রকাশ করেছিলেন।
হত্যাকাণ্ডে যাঁর যে ভূমিকা ছিল
২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঘোষিত রায়ে বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল প্রত্যেক আসামির ভূমিকা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেন। রায়ের ভাষায়, এটি ছিল একটি ‘ষড়যন্ত্রমূলক ও পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’।
ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ছিলেন পরিকল্পনার কেন্দ্রে। গুলির পর তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে সিনহার বুকে লাথি মারেন, পাঁজরের হাড় ভেঙে দেন এবং শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এ ছাড়া তিনি হাসপাতালে পাঠাতে বিলম্ব করা এবং ঘটনার আলামত নষ্ট করার মতো ঘটনাও ঘটান ওসি প্রদীপ। এখানেই থেমে থাকেননি ওসি প্রদীপ। দুটি মিথ্যা মামলা করে দোষ এড়ানোর চেষ্টাও করেন তিনি।
তবে পরিদর্শক লিয়াকত আলী ছিলেন মূল শ্যুটার। তিনি সিনহাকে লক্ষ্য করে সরাসরি গুলি করেন। পরে তাঁকে হাসপাতালে না নিয়ে ঘটনাস্থলেই রেখে দেন এবং সিনহার সঙ্গে থাকা সিফাতের বিরুদ্ধেও মিথ্যা মামলা করেন।
এসব কাজে প্রদীপের সহযোগী ছিলেন পুলিশের অন্য তিন সদস্য নন্দ দুলাল রক্ষিত, রুবেল শর্মা ও সাগর দেব। তাঁরা সিনহার গাড়ি থেকে ইয়াবা ও গাঁজা ‘উদ্ধারের’ নাটক সাজান এবং সিফাতকে নির্যাতন করেন। তাঁদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায়।
অন্যদিকে নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আইয়াজ ও মো. নিজাম উদ্দিন ছিলেন পুলিশের নিয়োজিত তিনজন সোর্স। তাঁরা সিনহাকে ডাকাত বলে অপপ্রচার চালান এবং হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করেন।
যেভাবে হত্যা করা হয় মেজর সিনহাকে
২০২০ সালে ৩১ জুলাই রাত প্রায় সাড়ে ৯টার দিকে হত্যার শিকার হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। প্রথমে মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে থামানো হয় তাঁর গাড়ি। গাড়ির ভেতরে তাঁর সঙ্গে ছিলেন সিফাত।
একটি তথ্যচিত্রের জন্য ‘টাইম ল্যাপস’ ভিডিও ধারণ করে তাঁরা পাহাড় থেকে ফিরছিলেন। সন্ধ্যার পর পাহাড়ে টর্চের আলো দেখে স্থানীয় লোকজনের মনে সন্দেহ জাগে। সেই সন্দেহই ছড়িয়ে পড়ে পুলিশের সোর্সদের মাধ্যমে। বিশেষ করে নুরুল আমিন নামের একজন সোর্স ফোনে ইনচার্জ লিয়াকত আলীকে সতর্ক করেন, পাহাড় থেকে সেনাবাহিনীর পোশাক পরা লোকজন নামছে, যারা নাকি ‘ডাকাত’! সোর্সের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে লিয়াকত কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই অভিযানে যান। তিনি কাউকে জানাননি, এমনকি ওসি প্রদীপকেও না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বিজিবি কিংবা সেনাবাহিনীর কাউকে অবগত না করে একাই সিদ্ধান্ত নেন ‘অ্যাকশনে’ যাওয়ার।
চেকপোস্টে গাড়ি থামলে কনস্টেবল রাজীব সিগন্যাল দেন। জানালা খুলে সিনহা নিজের পরিচয় দেন। এসআই শাজাহান সরে দাঁড়ান। ঠিক সেই মুহূর্তেই লিয়াকত সামনে এসে অস্ত্র তাক করে করে সিনহাকে গাড়ি থেকে নামার নির্দেশ দেন। নামতেই শুরু হয় গুলি।
তদন্ত কমিটির মতে, এই গুলি চালানো ছিল আত্মরক্ষার নামে এক অপ্রয়োজনীয় ও বেপরোয়া সিদ্ধান্ত। লিয়াকতের বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি মনে করেছিলেন, তাঁর জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। অথচ উপস্থিত অন্য পুলিশ সদস্যরা বলেন, তাঁদের কারও মনে হয়নি পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ ছিল। এমনকি এসআই শাজাহান বলেন, তিনি হলে গুলি করতেন না।
গুলির পর সিনহাকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও, প্রায় ২০ মিনিটের বেশি সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হননি ওসি প্রদীপ। তাঁর আসার পর আরও ২২ মিনিট পেরিয়ে যায়, এরপর ট্রাকে করে হাসপাতালে নেওয়া হয় সিনহাকে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারান সিনহা।
তদন্ত কমিটি একে ‘অপেশাদারি, দায়িত্বহীনতা এবং ক্রেডিট নেয়ার প্রতিযোগিতার’ করুণ পরিণতি বলে উল্লেখ করে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment