আজ বিশ্ব বই দিবস। কীভাবে জন্ম হলো এ দিবসের? আমাদের দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বইয়ের অনেক পেজ ও গ্রুপ থাকলেও এই বই দিবস ঘিরে কি কোনো আয়োজন আছে? জানাচ্ছেন মারুফ ইসলাম

আজ এক বন্ধুকে মিষ্টি হাসি দিয়ে বিশ্ব বই দিবস ও মেধাস্বত্ব দিবসের শুভেচ্ছা জানালাম। তিনি ‘হাসির বদলে হাসি’ না দিয়ে সামান্য জ্ঞান ঝাড়লেন।

জ্ঞানী অধ্যাপকদের মতো গলা খাঁকারি দিয়ে বন্ধুটি বললেন, ‘এসব বই দিবস–টিবস পালন করে হয়টা কি বল তো? কোনো লাভ আছে? পৃথিবীতে যখন বই ছিল না, তখন কি মানুষ জ্ঞান বিনিময় করেনি? জ্ঞান টিকে থাকেনি? আরে, বই ছাপানোর ইতিহাস তো খুব বেশি দিনের নয়। মাত্র ১ হাজার ১৫৪ বছর আগে পৃথিবীর প্রথম বইটি ছাপা হয়েছিল চীনে। তখনো বিদ্যুৎ-চালিত মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি। কাঠের ব্লক তৈরি করে হস্তচালিত যন্ত্র দিয়ে ছাপা হয়েছিল সেই বই। তার আগে কি পৃথিবী জ্ঞানশূন্য ছিল? জ্ঞানের আদান-প্রদান হয়নি? এসব দিবস টিবস চালু করার উদ্দেশ্য ব্যবসা, বুঝলি? ব্যবসা।’

ছোট্ট করে ‘হুঁ’ বলে প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলাম। পৃথিবীতে নৈরাশ্যবাদী মানুষের তো অভাব নেই। ২০২৩ সালের মার্চে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বিশ্বে ২৮ কোটি মানুষ নিরাশায় ভুগছে। গত দুই বছরে সেই সংখ্যা আরও বেড়েছে নিশ্চয়। সন্দেহ নেই, আমার বন্ধুটি সেই ২৮ কোটিরও বেশি নৈরাশ্যবাদী মানুষের মধ্যে একজন।

এঁদের বাইরেরও কোটি কোটি মানুষ আছেন, যাঁরা পৃথিবীটাকে ভিন্ন চোখে দেখেন। ইতিবাচক কিছু করতে চান। ভিসেন্তে ক্লেভেল আন্দ্রেস ছিলেন তেমন একজন। বাস করতেন স্পেনে। তাঁর বাতিক ছিল লেখালেখির। পরিচয় দিতেন লেখক হিসেবে। তাঁর মনে একবার প্রশ্নের উদয় হলো, ‘আচ্ছা, বই নিয়ে একটি দিন উদ্‌যাপন করলে কেমন হয়? সারা দিন মানুষ বই নিয়ে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা করল, অনুষ্ঠান আয়োজন করল? ব্যাপারটা মন্দ হয় না নিশ্চয়!’

যেভাবে এসেছিল বই দিবস

ব্যাপারটা আরও ভালো হয়, যদি বিখ্যাত কাউকে সম্মান জানিয়ে দিনটি উদ্‌যাপন করা যায়, মনে মনে ভাবলেন ভিসেন্তে। তারপর ১৯২২ সালের এক সুন্দর সকালে তিনি প্রস্তাব করলেন, ‘স্পেনের বিখ্যাত লেখক মিগুয়েল ডি সার্ভান্তেসকে সম্মান জানানো যেতে পারে বই দিবস পালনের মাধ্যমে।’ তাঁর প্রস্তাব স্পেন সরকার তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করেনি বটে, তবে চার বছর পর মিগুয়েল ডি সার্ভান্তেসের জন্মদিন ৭ অক্টোবরে স্পেনে প্রথম বই দিবস পালন করা হয়। এরপর ১৯৩০ সালে দিনটি পরিবর্তন করে মিগুয়েলের মৃত্যুর দিন ২৩ এপ্রিল বই দিবস পালন করতে শুরু করে স্পেন।

তারপর মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়ায়। অসংখ্যবার সূর্যের চারদিকে ঘুরে যায় পৃথিবী। দিনপঞ্জির পাতা উল্টে আসে ১৯৯৫ সাল। ওই বছর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেসকো তাদের সম্মেলনে মানুষকে বই পড়া এবং বই লেখায় উৎসাহিত করার জন্য একটি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। দিবসটি পালনের জন্য তারা বেছে নেয় ২৩ এপ্রিলকে।

কেন ২৩ এপ্রিল? কারণ স্পেনের বাসিন্দারা সেই ১৯৩০ সাল থেকে দিনটিকে বই দিবস হিসেবে পালন করছে। তা ছাড়া দিনটি পৃথিবী বিখ্যাত লেখক উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার ও ইনকা গারসিলাসো দে লা ভেগার মৃত্যুদিন। এই দিনকে বই দিবস এবং মেধাস্বত্ব দিবস হিসেবে উদ্‌যাপন করলে ভিসেন্তে ক্লেভেল আন্দ্রেসের পাশাপাশি শেক্‌সপিয়ার আর গারসিলাসোকেও শ্রদ্ধা জানানো হবে।

আরও একটি কাজ হবে বলে মনে করে ইউনেসকো। সেটি হলো—বই পড়তে উৎসাহিত হবে মানুষ। উৎসাহিত হবে বই লিখতেও। আর মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন হবে।

সেই থেকে ২৩ এপ্রিল পৃথিবীব্যাপী ‘বিশ্ব বই দিবস ও মেধাস্বত্ব দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য ঠিক করে দেয় ইউনেসকো। এ বছর বিশ্ব বই দিবসের প্রতিপাদ্য—‘যদি চান টেকসই উন্নয়ন, সাহিত্য করুন।’

কেন বই শহর

ইউনেসকো আরও একটি কাজ করে। ২০০১ সাল থেকে প্রতিবছর একটি শহরকে ‘বই শহর’ ঘোষণা করে। এ বছর ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরকে ‘বই শহর’ ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো।

এই শহরকে ঘিরে এ বছর ইউনেস্কো নানা কর্মসূচি পালন করবে। বই কীভাবে সহিংসতা মোকাবিলা করে এবং শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলে, সেসব নিয়ে আলোচনা করা হবে। ইউনেস্কো বলছে, এ বছর কর্মসূচিগুলো তিনটি বিষয়কে লক্ষ্য করে করা হবে। সেগুলো হলো, গণপরিসর উদ্ধার করা, সামাজিক বন্ধন গড়ে তোলা এবং সংহতি প্রতিষ্ঠা।

বিশ্ব বই দিবসের বৈশ্বিক স্বীকৃতির পর কেটে গেছে ৩০টি বছর। কিন্তু বাংলাদেশে দিবসটি নিয়ে তেমন হেলদোল চোখে পড়ে না। তেমনভাবে নেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্‌যাপন। মানুষের মধ্যে সচেতনতাও দেখা যায় না। অনেকেই হয়তো জানেন না আজ বিশ্ব বই দিবস। এমনকি অনেক লেখকও হয়তো ওয়াকিবহাল নন যে তাঁদের মেধাস্বত্ব নিয়ে একটি দিন আছে।

এখন তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রমরমা সময়। নানা দিবসকে কেন্দ্র করে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে নীল-সাদার ফেসবুক দুনিয়া। কিন্তু বই দিবসে কি তেমন তৎপরতা চোখে পড়ছে?

বই নিয়ে বেশ কয়েকটি ফেসবুক গ্রুপ আছে আমাদের দেশে। লাখ লাখ সদস্য সেসব গ্রুপে। নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা চলে সেখানে। কিন্তু দিবসে এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই চোখে পড়ল না।

তবু আশাহত হলে চলবে না। হয়তো কোনো একদিন ঢাকা শহরকেও বই শহর ঘোষণা করবে ইউনেস্কো। বই নিয়ে তৎপরতা বাড়বে মানুষের মধ্যে। বই হয়ে উঠবে নিত্যসঙ্গী।

বই এমন এক মাধ্যম যার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বই অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দেয়’। আবার চাণক্যর কথা, ‘বিদ্যা যাহাদের নাই, তাহারা ‘সভামধ্যে ন শোভন্তে।’ আর কে না জানে, বিদ্যা অর্জন করার এক অনবদ্য অনুষঙ্গ হচ্ছে বই।

কাজেই বই দিবস সাড়ম্বরে পালন করা হোক আর না হোক, বইয়ের আবেদন কখনো ফুরাবে বলে মনে হয় না। যত দিন পৃথিবী থাকবে, তত দিন মানুষের নিঃসঙ্গ প্রহরে বই জ্বেলে যাবে জ্ঞানের প্রদীপ। কোনো শ্রান্ত দুপুরে, কিংবা বিষণ্ন বিকেলে বই হয়ে উঠবে প্রিয় সঙ্গী। ঘুম ঘুম শীতের রাতে অচিন কুয়াশার মতো জড়িয়ে ধরবে বই। একটি বই অনেক কিছু মনে করিয়ে দেবে আমাদের। বই দিবস অমর হোক।

তথ্যসূত্র: দ্য হিন্দুস্তান টাইমস, দিয়ারিও এএস (স্পেনের পত্রিকা), ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট ও রবীন্দ্র রচনাবলি