শাহরুখের ছবি তুলে আলোচনায় আসা কে এই আমির হামজা
ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্য, বিশ্ব ফ্যাশনের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ইভেন্ট ‘মেট গালা’-এর ৭৭ বছরের ইতিহাসে এবারের আসরেই প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছেন বলিউডের কোনো পুরুষ অভিনেতা। অনেকটা অবধারিতভাবেই এই ইতিহাস গড়েছেন ৫৯ বছর বয়সী বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খান।
আলোক ঝলমলে নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টসে ডিজাইনার সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ে নকশা করা কালো রঙের পোশাকে কার্পেটে হেঁটে শাহরুখ সেখানে নজর কেড়েছেন সবার। শাহরুখের এই ঐতিহাসিক মুহূর্তকে ফ্রেমে ধরে রেখে ইতিহাস গড়েছেন এক বাংলাদেশী তরুণ। তিনি নিউ ইয়র্কভিত্তিক বাংলাদেশী আলোকচিত্রী আমির হামজা।
মেট গালায় শাহরুখের ছবি প্রকাশের পরই নতুন করে আলোচনার এসেছেন এই আলকচিত্রী। শুধু শাহরুখই নয়; হামজার লেন্সে এর আগে বন্দি হয়েছেন এলন মাস্ক, ব্রেন্ডন ফ্রেজার, নোভাক জোকোভিচ, কোয়েন্টিন ট্যারান্টিনো, জুলিয়া ফক্স, ক্রিস পল, মীরা নায়ার সহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক তারকা।
এবারের মেট গালা ইভেন্ট কাভারের দায়িত্ব ছিল তাঁর উপর। শুধু মেট গালা–ই নয়, অস্কারের ৯৬তম আসরে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের জন্য ছবি তুলেছিলেন তিনি। এর আগে বিভিন্ন সময়ে তাঁর ছবি ছাপা হয়েছে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ব্লুমবার্গ, ডি ভলকস্ক্রান্ট (নেদারল্যান্ডস), দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ান, এবং বোর্শেন (ডেনমার্ক)-এরমতসংবাদমাধ্যমে।
পেশাজীবনে হামজা অফিশিয়াল ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস–এ । গণমাধ্যমটির তিনি এখনও যুক্ত আছেন স্বাধীন আলোকচিত্রী হিসেবে ।
ক্যামেরার সাথে পথচলা
আমির হামজা চট্টগ্রামের ছেলে। জন্ম ১৯৯২ সালে। ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল ফার্মাসিস্ট হবেন। ২০১৪ সালে চট্টগ্রামের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে ফার্মেসি বিষয়ে স্নাতক পাশ করেছেন। তবে তার মন পড়ে ছিল ক্যামেরার পেছনে, লেন্সের ভেতর দিয়ে মানুষের গল্প বলার প্রবল ইচ্ছা ছিল তাঁর। ২০১১–১২ সালের দিকে, ইরানি ও কোরিয়ান সিনেমা দেখে ক্যামেরার ভাষার প্রেমে পড়েন তিনি।। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাননি। স্নাতক পাশের আগেই মনস্থির করেছিলেন ক্যারিয়ার গড়বেন এ জগতেই।
এরপর ২০১৪ সালে স্ট্রিট ফটোগ্রাফির মধ্য দিয়ে শুরু ক্যামেরার সাথে তাঁর পথচলার। সেই পথচলায় পাকস্থলীকে শক্তি জোগাতে তখন ‘ওয়েডিং ফটোগ্রাফি’ করে হামজা খুঁজে নিয়েছিলেন আয়ের উৎস।
২০১৬ সালে পুরান ঢাকার সাকরাইন উৎসবে হামজার ধারণ করা কিছু ছবি তোলেন নজরে পড়ে নির্মাতা পিপলু আর খানের। পিপুল তাকে যুক্ত করে নেন নিজের প্রযোজনা সংস্থা অ্যাপলবক্স ফিল্মসের সাথে। স্যার ফজলে হাসান আবেদকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ কাজে যুক্ত ছিলেন হামজা। এটিই ছিল তাঁর প্রথম পেশাদার কাজ।
আন্তর্জাতিক যাত্রা
২০১৭ সাল, চট্টগ্রামের তরুণ আমির হামজার জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। আলোকচিত্রের প্রতি ভালোবাসা তখন তাকে এবার নিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের আরেক প্রান্তে। একটি আন্তর্জাতিক স্কলারশিপ অর্জন করে তিনি পাড়ি জমান নিউ ইয়র্কে, পড়াশোনা করেন বিখ্যাত International Center of Photography-তে। সেখানে হাতে–কলমে শেখেন আলোকচিত্র ও সিনেমাটোগ্রাফির জটিল ভাষা।
২০১৯ সালে বড় সুযোগ আসে তার সামনে। নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় রাজনৈতিক কমেডি শো ‘Patriot Act with Hasan Minhaj’ এ অফিসিয়াল ফটোগ্রাফার হিসেবে নিয়োগ পান হামজা। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে যুক্ত হয় নতুন এক অধ্যায়ের।
এরপর ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে কৃশাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তীকালে বিক্ষোভ আন্দোলনের সময় হামজা ছিলেন নিউ ইয়র্ক শহরের রাস্তায়, ক্যামেরা হাতে। জনতার ক্ষোভ এবং প্রতিবাদ তিনি বন্দি করেন নিখুঁত ফ্রেমে। এই ছবিগুলোই বদলে দেয় তাঁর জীবনের গতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ নানা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জায়গা পায় তাঁর তোলা ছবি। তখন থেকেই দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ানের মত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিং ফটোগ্রাফার হিসেবে ছবি তোলার শুরু।
তাঁর কাজের পরিধি শুধু বিনোদন বা ফ্যাশানে সীমাবদ্ধ নয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস–এ তিনি “A Risky Wager” নামের অনুসন্ধানী সিরিজের ছবিও তুলেছেন, যেখানে অনলাইন স্পোর্টস বেটিং নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। এতসব সাফল্যের উপর ভর করে ২০২৩ সালে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস–এর ফটো জার্নালিজম ফেলোশিপ প্রোগ্রামে।
পুরস্কার ও সম্মাননা
- ২০১৫: Sony World Photography Award – ৩য় (বাংলাদেশ)
- ২০১৬: EyeEm ‘People and Places’ – ১ম (বার্লিন, জার্মানি)
- ২০১৭: Sony World Photography Award – ১ম (বাংলাদেশ)
- ২০১৮: ‘The World We Live In’ by Pied à Terre – ২য় (ফ্রান্স)
- ২০২৩: Young Guns 21 Winner – The One Club (যুক্তরাষ্ট্র)
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment