×

মিসেস ডালওয়ের ১০০ বছর ও ভার্জিনিয়া উলফের আত্মজিজ্ঞাসা 

শতবর্ষ পূরণ হলো ১৯২৫ সালে প্রকাশিত ভার্জিনিয়া উলফের উপন্যাস ‘মিসেস ডালওয়ে’র। উপন্যাসটি ছিল মানুষের মনোজগত, স্মৃতি ও আত্মজিজ্ঞাসার এক গভীর আয়না। উপন্যাসটিতে থাকা অস্তিত্বের গভীর প্রশ্নগুলো নিয়ে লিখেছেন শতাব্দীকা ঊর্মি

১৯২৫ সালের এক উজ্জ্বল দুপুর।  দিনটি চিল একেবারে সাধারণ। লন্ডনের অলিগলি ভেদ করে এক অভিজাত ইংরেজ নারী ক্লারিসা ডালওয়ে বেরিয়ে পড়েন ফুল কিনতে।

তবে এই তথাকথিত সাধারণ দিনের আবরণ খুলে ভার্জিনিয়া উলফ আমাদের টেনে নিয়ে যান এক অন্য ঠিকানায়। যেখানে সময় কেবল ঘড়ির কাঁটায় নয়, দোল খায় মনের গহিনে। এখানে

একেকটি চিন্তা, একেকটি স্মৃতি, একেকটি দোল খাওয়া মুহূর্ত—সময়কে ছিন্নভিন্ন করে বুনে তোলে অস্তিত্বের এক জটিল জাল।

আজ থেকে ঠিক এক শতাব্দী আগে প্রকাশিত ভার্জিনিয়া উলফের লেখা  ‘মিসেস ডালওয়ে’ কেবল একটি উপন্যাস নয়— তা ছিল আধুনিকতাবাদী সাহিত্যের এক বিপ্লবী ধ্বনি। এই উপন্যাসে উলফ দেখান, দৈনন্দিনতার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে অস্তিত্বের গভীর রূপান্তর। এমনকি একটি পার্টির প্রস্তুতিও হতে পারে আত্মজিজ্ঞাসার আয়না, শহরের গলিতেও হাঁটাও হতে পারে স্মৃতির সঙ্গে অস্তিত্বগত আলাপ।

এই উপন্যাসের শতবর্ষের প্রেক্ষিতে ফিরে দেখা যাক সেই সাহিত্যকর্ম, যা নারীর মনোজগত, অস্তিত্বগত প্রশ্ন, মানসিক আঘাত ও স্মৃতির বুননকে নতুন চেহারায় বিশ্বসাহিত্যে উপস্থাপন করেছিল।

কোনো ঘটনার মধ্যে দাঁড়িয়ে মনের ভেতর বয়ে চলা চিন্তাকে প্রকাশ করার এক রীতি সাহিত্যে প্রচলিত আছে। যাকে বলা হয় চেতনাপ্রবাহ রীতি। উলফের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক কৌশল ছিল এটি।

ক্লারিসা ফুল কিনতে যান। কিন্তু তার মনে ভেসে ওঠে পুরোনো প্রেমিক পিটার ওয়ালশ, স্যালি সেটন থেকে শুরু করে তার জীবনের অন্যান্য বাছাইগুলোর প্রতি গভীর অনুশোচনা।

সেই উপন্যাসে আরেক চরিত্র সেপটিমাস ওয়ারেন স্মিথ। সেই চরিত্রকে ঘিরে তৈরি হয় আরেক জগৎ। যেখানে যুদ্ধোত্তর ট্রমা, আত্ম বিচ্ছিন্নতা ও আত্মহননের সিদ্ধান্ত জট পাকতে থাকে একসাথে ।

এই দুই চরিত্রের চেতনাপ্রবাহ পাঠককে এমন এক ভ্রমণে নিয়ে যায় যেখানে বাইরের ঘটনার চেয়ে মনের অন্তর্লোক হয়ে উঠে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

নারীর পরিচয় ও মিসেস ডালওয়ে

‘মিসেস ডালওয়ে’ নারীবাদী পাঠের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্লারিসার চরিত্রটি আবদ্ধ, আত্মসংশয়ী, চিন্তাশীল ও গভীর সংবেদনশীল। সে সমাজের চোখে একজন ‘সফল’ গৃহিণী। সাংসারিক ও সামাজিক অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তার ভেতরে যে টানাপড়েন, যৌবনের পছন্দ, ভালবাসা ও ইচ্ছার দমন, তা  নারীর আত্মপরিচয়ের খোঁজে থাকা এক যাত্রাকে উপস্থাপন করে।

উলফ এখানে নারীর যৌনতা, ভালবাসা ও আত্মস্বীকৃতির মতো বিষয়কে সাহসিকতার সঙ্গে স্পর্শ করেছেন। স্যালির প্রতি ক্লারিসার প্রেমময় অনুভূতি, পিটারের সঙ্গে সম্পর্কের অসম্পূর্ণতা, এবং বিয়ের মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষা বেছে নেওয়ার অসন্তুষ্টিকে  তুলে এনেছেন উলফ।

নারীবাদী দার্শনিক হেলেন সিক্সাস তাঁর ‘লাফ অব মেডুসা’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘নারীর লেখা মানেই নতুন এক ভাষার উন্মোচন—যা ঐতিহ্যবাহী পুরুষতান্ত্রিক ভাষার দমনমূলক গঠন ভেঙে দেয়।’

সেপটিমাস ও আত্মার প্রতিবাদ

সেপটিমাস চরিত্রটি যেন উলফের সত্তার একটি কল্পিত রূপ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এই যোদ্ধা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, অবসাদের শিকার। উপন্যাসের এক পর্যায়ে সে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ।

তার মৃত্যু ক্লারিসার মনে এক ধরনের অনুরণন তৈরি করে। ক্লারিসার মনে হয়,  সে যেন জীবনের এক বিকল্প পথ, যে পথ ক্লারিসা বেছে নেননি কিন্তু অনুভব করেন। সেপটিমাস চরিত্রের মধ্য দিয়েই উলফ মানসিক ব্যথা কে নীরবতার বদলে সাহিত্যিক প্রতিবাদের ভাষায় রূপান্তর করেন।

ফিরে দেখার এক শতাব্দী

আজ এক শতাব্দী পরে, ‘মিসেস ডালওয়ে’ হয়ে উঠেছে আরও প্রাসঙ্গিক। যখন বিশ্বজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তৈরি হচ্ছে সচেতনতা, যখন নারীর আত্মপরিচয় ও যৌনতা নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, তখন উলফের উপন্যাস দেখায়, এই আলোচনা আচমকাই শুরু হয়নি। সাহিত্য বহু আগেই এই প্রশ্ন তুলেছে, এবং ‘মিসেস ডালওয়ে’ সেই প্রশ্নগুলোর অন্যতম সূচনা বিন্দু।

ভার্জিনিয়া উলফ নিজেও মানসিক জটিলতা, নারীবাদী চেতনা ও শৈল্পিক স্বাতন্ত্র্যের এক জটিল মিশেল। তাঁর জীবন ও সাহিত্য দেখায়, আত্মজিজ্ঞাসাই হয়তো সবচেয়ে বড় সাহসিকতা।
‘মিসেস ডালওয়ে’ একটি দিনে শুরু হয়ে একটি পার্টিতে শেষ হলেও, এটি আসলে একটি জীবনের, একটি সমাজের রূপান্তরের আখ্যান। এখানে সময় মানে কেবল গতির পরিমাপ নয়। এটি স্মৃতি, ব্যথা, প্রেম, এবং আত্ম সন্ধানের এক অবিরাম ধারা।

১০০ বছর পরেও, ভার্জিনিয়া উলফের এই সৃষ্টি মনে করিয়ে দেয় যে, সাহিত্য কেবল গল্প নয়—এটি এক ধরনের সত্য, এক ধরনের প্রতিবাদ, এবং এক ধরনের আশ্রয়।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment