×

মার্ক জাকারবার্গ:  সংযোগের নায়ক না তথ্যের শাসক?

আজ ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের জন্মদিন।  ২০০৪ সালে হার্ভার্ডের একটি ছাত্রাবাস থেকে শুরু হয়েছিল ফেসবুকের যাত্রা। তরুণ মার্ক জাকারবার্গের সেই প্রচেষ্টা সময়ের সঙ্গে রূপ নেয় এক বৈশ্বিক প্রযুক্তি বিপ্লবে। তথ্য বিনিময়, সামাজিক সংযোগ ও ভবিষ্যতের ইন্টারনেট – মেটাভার্স – ঘিরে গড়ে ওঠা এই গল্পের বিকাশ ও নৈতিকতার দ্বন্দ্ব নিয়ে লিখেছেন সৈকত আমীন। 

২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারির এক শীতল দিন। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্রাবাসে বসে এক তরুণ একটি ওয়েবসাইট চালু করলেন। নাম দিলেন – ফেসবুক। তার উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার: মানুষের মধ্যে তথ্য বিনিময় সহজ করা, একটি উন্মুক্ত, সংযুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা। সেই তরুণ ছিলেন মার্ক জাকারবার্গ – যিনি অচিরেই হয়ে উঠবেন পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী প্রযুক্তি উদ্যোক্তা।

জাকারবার্গ নিজের কোম্পানির আইপিও জমা দেওয়ার সময়ই এক খোলা চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ফেসবুক কোনো কোম্পানি হিসেবে শুরু হয়নি, এটি একটি সামাজিক মিশন – যেন পৃথিবীকে আরও উন্মুক্ত ও সংযুক্ত করা যায়।’ এই মিশনই তাকে এগিয়ে নেয়, প্রযুক্তির সীমা ভেঙে নতুন নতুন সংযোগের সম্ভাবনা গড়তে।

ফেসবুক থেকে বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক

ফেসবুকের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল মানুষকে অনলাইনে যুক্ত রাখা – বন্ধুদের খোঁজ, পরিবারের সঙ্গে সংযোগ, মতামতের আদানপ্রদান, এবং একসঙ্গে ভার্চুয়াল সমাজ গড়ে তোলা। তবে ধীরে ধীরে এই প্ল্যাটফর্মটি হয়ে ওঠে সামাজিক আন্দোলনের চালিকাশক্তি, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার বাজার, এমনকি ভালোবাসার সেতুবন্ধনও।

তবে এই সংযোগের গল্প কেবল এখানেই থেমে থাকেনি। ২০১৩ সালে জাকারবার্গ চালু করেন ইন্টারনেট ডট ওআরজি নামের এক উদ্যোগ। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সহজে ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়া ছিল এই উদ্যোগের লক্ষ্য জাকারবার্গের ভাষায়, ‘বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এখনও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে না’ আমি সেই ব্যবধান কমাতে চাই প্রযুক্তিকে পজিটিভ শক্তি হিসেবে কাজে লাগিয়ে।’

মেটা ও মেটাভার্সের পথে যাত্রা 

২০২১ সালে ফেসবুক কর্পোরেশন নতুন নাম দেয়া হয় মেটা প্ল্যাটফর্মস। এটি শুধু একটি রিব্র্যান্ডিং ছিল না, বরং ছিল ভবিষ্যতের দিকে এক সাহসী পদক্ষেপ। 

জাকারবার্গের চোখে মেটাভার্স হচ্ছে ইন্টারনেটের পরবর্তী রূপ। এমন এক ভার্চুয়াল বাস্তবতা যেখানে মানুষ শারীরিক উপস্থিতি ছাড়াই একসঙ্গে কাজ করা, শেখা, আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারবে। যেখানে স্ক্রিনের বাইরে গিয়ে ভার্চুয়াল জগতের গভীরে ডুব দেওয়া যাবে। জাকারবার্গ এখন কেবল মানুষের মধ্যে নয়, বরং মানুষ ও এআই-এর মধ্যকার সংযোগের ভবিষ্যৎ গড়তে চান।

সামাজিক দায়িত্ব বনাম প্রযুক্তির ক্ষমতা

ফেসবুকের যাত্রা শুধু সাফল্যের গল্প নয় – সমালোচনার অধ্যায়ও দীর্ঘ। ২০১৮ সালের ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি ফেসবুকের তথ্য গোপনীয়তা নিয়ে বড় প্রশ্ন তোলে। রোহিঙ্গা সংকটে প্ল্যাটফর্মটির ভূমিকা, ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ – সব মিলিয়ে কোম্পানিটির নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে বিতর্ক বাড়তে থাকে।

জাকারবার্গ অনেকবার স্বীকার করেছেন ‘আমরা কিছু ক্ষেত্রে ভুল করেছি, , এবং ভবিষ্যতে আরও স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল হতে চাই’। 

যদিও এখনও ইউরোপ ও আমেরিকায় একচেটিয়া ক্ষমতা ও তথ্য নিরাপত্তা ইস্যুতে মামলা চলছে মেটা প্লাটফর্মের বিরুদ্ধে।

দর্শনের প্রযুক্তি ও প্রযুক্তির দর্শন

ফেসবুক থেকে মেটা – জাকারবার্গের এই যাত্রায় একদিকে আছে অনন্য সাফল্য, বৈশ্বিক সংযোগ, সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের গল্প। অন্যদিকে আছে ব্যক্তিগত তথ্যের ঝুঁকি, মনস্তাত্ত্বিক আসক্তি, এবং প্রযুক্তির অপব্যবহারে উদ্বেগ।

তবে জাকারবার্গের লক্ষ্য এখনও অটুট: ‘সবাইকে কণ্ঠ মেলানোর সুযোগ দিলে সমাজ শক্তিশালী হয়।’ 

এই বিশ্বাস থেকেই তিনি কাজ করে চলেছেন এক এমন ভবিষ্যতের দিকে – যেখানে প্রযুক্তি শুধু হাতের ডিভাইসে নয়, মানুষের অনুভব ও অস্তিত্বে জড়িত থাকবে। প্রশ্ন এখন একটাই – এই ভবিষ্যত কি সত্যিই আমাদের আরও কাছে নিয়ে আসবে, না কি আরও বিভেদ সৃষ্টি করবে প্রযুক্তির ক্ষমতাধর ও ক্ষমতাহীনদের মাঝখানে। 

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment