×

যে কারণে মধ্যবিত্তের গল্প বলা মৃণাল সেন আজও প্রাসঙ্গিক

চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের জন্মদিন ১৪ই মে। তাঁর সিনেমায় মধ্যবিত্ত সমাজের কথা এসেছে বারবারই। মৃণালের সিনেমায় মধ্যবিত্তের গড়নটি কেমন? লিখেছেন গৌতম কে শুভ

তাঁর সিনেমা আলো ছড়ায়। আবার অন্ধকারে ডুবে যাওয়াও দেখায়। তিনি জানতেন, সব গল্প আলোতে বলা যায় না। কিছু গল্প বলতে হয় ছায়া দিয়ে। পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরে জন্ম নেওয়া এক চলচ্চিত্রকারের কথা বলছি। তিনি মৃণাল সেন। ‘আকালের সন্ধ্যানে’, ‘আমার ভুবন’খ্যাত এই মানুষটি শুধু একজন চলচ্চিত্রকার নন। ছিলেন সময়ের কথকও। সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা দ্বিধা, ভয় আর ছলনার পরতগুলোকে তুলে এনেছিলেন বড়পর্দায়। 

বাংলা সিনেমার তিন কিংবদন্তি সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক। সিনেমায় ভিন্ন ভিন্ন ধারার পথিক হলেও তাঁদের পথটি একসূত্রে বাঁধা, সেটা পূর্ববঙ্গ। সত্যজিৎ পূর্ববাংলায় না জন্মালেও মৃণাল আর ঋত্বিকের যৌবনের একটা সময় কেটেছে এখানেই। দেশভাগ তাঁদের সীমানা বদলে দিয়েছিল, মন নয়। 

মৃণালের সিনেমায় তাই বারবার ফিরে আসত মধ্যবিত্তের সংকট, অভাব-অভিযোগ। আর একটি নির্মম সত্য, জীবনে বাঁচা মানে প্রতিদিনের লড়াই। নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংগ্রাম এবং জীবনকে নানামুখী বাস্তবতায় তিনি যেমন দেখেছেন, তেমনি আমাদের দেখিয়েছেনও। আদতে সিনেমায় সবসময় এসবের অর্থই খুঁজে গেছেন মৃণাল।

তখন বৃটিশ শাসনের কাল। ১৯২৩ সালের ১৪ মের আজকের দিনে ফরিদপুরে জন্মেছিলেন মৃণাল সেন। এ এলাকার বিখ্যাত রাজেন্দ্র কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। তারপর কলকাতায় গমন এবং পাকাপাকিভাবে এখানেই বসবাস। প্রেসিডেন্সি কলেজ, মার্কসবাদ, রাজপথ, সিনেমা – সব কিছু তাঁর কাছে এসেছিল এই কলকাতাতেই।

প্রথম সিনেমা ‘রাতভোর’ (১৯৫৬) থেকে ‘আমার ভুবন’ (২০০২) – গোটা একটা জীবনে যা দেখেছেন, তা-ই তুলে ধরেছেন পর্দায়। নির্মাণ করেছেন ৩০টির মতো ছবি। অথচ এক জায়গায় থেমে থাকেননি কখনো। গল্পের ধরন, বলার ভঙ্গি, পটভূমি- সবই পাল্টেছে তাঁর যাপন ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। 

প্রথমদিকে তিনি গল্প বলতেন। পরে দেখালেন গল্প নয়, গল্পের প্রতিক্রিয়া কতটা গভীর হতে পারে। ধারাবাহিকতা ছেড়ে টুকরো টুকরো দৃশ্য জুড়ে একেকটা অভিজ্ঞতা। মন্তাজের ভেতর দিয়ে ধরলেন সময়ের ব্যাখ্যা আর প্রশ্নের মর্ম।

মৃণালের গড়া বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত মুখগুলোর চোখে কোনো উত্তেজনা দেখা যায়নি। কিন্তু ভেতরে জমা ছিল ভয়, দ্বিধা আর সংকট। ‘ আকালের সন্ধান ‘, ‘খারিজ’, ‘একদিন প্রতিদিন’ – এসব সিনেমায় মধ্যবিত্তের যে গড়ন, তা এমনই। এই শ্রেণি আবার বড় স্বপ্ন দেখে। কিন্তু ছোট সংকটেও কেঁপে ওঠে। বিপ্লবের কথা বলে আবার বিপ্লব করতে ভয় পায়। মৃণালের চরিত্রেরা স্লোগান তোলে, আবার সুবিধার দিকেও ঝুঁকে পড়ে। সব মিলিয়ে মৃণাল মধ্যবিত্ত শ্রেণির সামনে তুলে ধরেন এমন এক আয়না, যাতে সে দেখতে পারে নিজের অবয়ব।

খারিজ’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘এক দিন প্রতিদিন’: যা দেখতে পাই 

‘খারিজ’ সিনেমার সেই রান্নাঘরের কথা মনে আছে? পুরোনো কলকাতার একটা মাঝারি বাড়ির ভেতরের অংশ। এই রান্নাঘরেই একদিন মরে যায় চাকরু হিসেবে কাজ করা ছেলেটা। অল্প বয়সের। কেউ তাকে খুন করেনি। কেউ কিছু বলেওনি। তবু একটা মৃত্যু হয়ে গেল। এখানে দোষটা কার? এই দ্বিধা-দ্বন্দে মনোস্তাত্ত্বিক এক লড়াই চলে পরিবারটির মধ্যে। তাদের ভয় পুলিশ আর লোকলজ্জায়। আবার খানিকটা অপরাধবোধও কি নেই? এখন ছেলের বাবাকে কী বলবে তারা? যে করেই হোক খুশি করতে হবে তার বাবাকে। 

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না, কেবল বিবেকের দংশন ছাড়া। এই দংশন কখন যে দর্শককেও আচ্ছন্ন করে তোলে! আমরা যেন নিজের মুখটি দেখতে পাই।

‘আকালের সন্ধানে’তে দেখা যায় তেতাল্লিশে বাংলার দুর্ভিক্ষ নিয়ে একটি সিনেমা বানাতে গ্রামে গিয়েছে পরিচালক, সঙ্গে লটবহরসহ ইউনিট। উদ্দেশ্য ইতিহাসকে ক্যামেরায় বন্দী করা। তবে এখানে বাস্তবতা ধরা দেয় অন্যভাবে। গ্রামে এখনও দুর্ভিক্ষ। কিন্তু তা অন্য রকমের–চাকরি নেই, চিকিৎসা নেই, নেই শিক্ষার সুযোগ। শহর থেকে আসা ইউনিটের লোকেরা বোঝে, যে দুর্ভিক্ষের কথা ওরা ভেবেছে, তা আছে শুধু বইয়ের পাতায়। বাস্তবতা আরও নির্মম। মৃণাল সেন এখানে প্রশ্ন তোলেন, আমরা কি শুধুই ইতিহাস খুঁড়ে দেখতে জানি? বর্তমান চোখে পড়ে না! 

আবার ‘এক দিন প্রতিদিন’-এ পরিবারে উপার্জন করা মেয়েটি হঠাৎ একদিন বাড়ি ফেরে না। কোনো ব্যাখ্যা নেই, নেই কোনো বিপদ-সংবাদও। 

মেয়ের এই অনুপস্থিতিতে গোটা পরিবারের চেহারা বদলে যেতে থাকে। সন্দেহ, উদ্বেগ, রক্ষণশীলতার মুখোশ খসে পড়ে একে একে। ছবিতে যে উদ্বিগ্নতা দেখা যায়, তা থেকেও ভিন্ন এক প্রশ্ন দর্শকের সামনে হাজির করেন মৃণাল, পরিবারের উদ্বিগ্নতা কি মেয়েকে নিয়ে, নাকি প্রধান উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারানোর শঙ্কাও কাজ করছে এখানে? 

এভাবেই সিনেমার দৃশ্যে দৃশ্যে নানান প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে দর্শককে ভাবতে বাধ্য করেন মৃণাল সেন।

বলা যায়, মৃণালের সিনেমা যেন বড় শহরের ছোট ফ্ল্যাটের গল্প। চাকরির খোঁজে ঘুরে বেড়ানো যুবক। ইন্টারভিউ দিতে যাবে। কিন্তু হঠাৎ জামাটা ঠিকঠাক পাওয়া যাচ্ছে না। আবার আদর্শ নিয়ে দ্বিধায় পড়া মানুষ ও তাঁর গল্প, কী নেই এই চলচ্চিত্রকারের সেলুলয়েডে! 

কেন তিনি আছেন

মৃণাল সেন এখনো প্রাসঙ্গিক। সিনেমাজীবনে বারবার বারংবার তিনি এমন এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির মুখ তুলে ধরেছিলেন, যাঁরা আমাদের চারপাশে আজও বেঁচে আছে – আরও দ্বিধাগ্রস্ত, ক্লান্ত। তবুও তাঁরা বেঁচে আছে সস্তা নৈতিকতার মুখোশে।

 

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment