×

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডিঙিয়ে যেভাবে এল কান চলচ্চিত্র উৎসব

১৩ মে ফ্রান্সের কান শহরে পর্দা উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব ‘কান’-এর ৭৮তম আসরের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে চলচ্চিত্র উৎসব যখন ফ্যাসিবাদের কালো ছায়ায় ঢাকা পড়ছিল, তখনই কীভাবে জন্ম হয়েছিল এ আয়োজনের? কান উৎসবের আদ্যোপান্ত ঘেঁটে এর শুরুর ইতিবৃত্ত তুলে ধরেছেন গৌতম কে শুভ 

সময়টা ১৯৩২ সালের ৬ আগস্ট। শিল্পের শহর ইতালির ভেনিসে তখন উত্‍সবের আমেজ । ভেনিস বিয়েনালের ১৮তম আয়োজনের এক ভিন্ন শাখায় প্রথমবারের মতো পর্দা উঠেছিল চলচ্চিত্র উৎসব নামের অভিনব এক অনুষ্ঠানের। আর ইতিহাসের পাতায় সেদিনই লেখা হয়ে গেল বিশ্ব চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথম অধ্যায়, ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের। এই ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব থেকেই তৈরি হয়েছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবের ভাবনা।

কেন ভেনিস থেকে কানে যাত্রা

কয়েক বছর যেতে না যেতেই ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের সেই রঙিন আলোর নিচেই জমতে শুরু করে কালো ছায়া। কারণ জার্মানিতে তখন ক্ষমতায় অ্যাডলফ হিটলার। আর ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনি। একনায়কতন্ত্রের এই দুই মুখ যেন হাত মিলিয়ে বদলে দিচ্ছিলেন কেবল রাষ্ট্র নয়, শিল্পের ছবিও। আর তার আঁচ এসে পড়েছিল ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবেও।

১৯৩৮ সালের উৎসবে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে পড়ে। ১৯৩৬ সালের জার্মানির বার্লিনের বিতর্কিত অলিম্পিকের পক্ষে হিটলারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু লেনি রাইফেনশালের তৈরি প্রোপাগান্ডামূলক তথ্যচিত্র ‘অলিম্পিয়াড’ বিজয়ী হয়। সঙ্গে ছিল আরেক বিতর্কিত যুদ্ধভিত্তিক ছবি‘লুসানো সেররা, পিলোটা’, পরিচালনা করেন ইতালির গোফ্রেডো আলেসান্দ্রিনি। তখন এ দুই সিনেমার শিল্পমান নিয়ে বিতর্ক ছিল তুঙ্গে। ছবি দুটি আবার দর্শকেরও মন জয় করতে পারেনি।

এই ঘটনার প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্র-নির্মাতারা। তাঁদের ক্ষোভ শুধু রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নয়, বরং শিল্পের অপমানের বিরুদ্ধেও। তখনই ফরাসি কূটনীতিক ও ইতিহাসবিদ ফিলিপ এরলিঙ্গারের মাথায় আসে নতুন ভাবনা। চলচ্চিত্রের জন্য চাই স্বাধীন এক মঞ্চ, যেখানে রাজনীতি নয়; বরং রাজত্ব করবে সৃজনশীলতা। এভাবেই শুরু হয় কান চলচ্চিত্র উৎসরের যাত্রা।

শহর হিসেবে কেন ‘কান’কে বেছে নেওয়া হলো

নতুন ভাবনার এই চলচ্চিত্র উৎসবের প্রস্তুতিপর্বে ফিলিপ এরলিঙ্গারের সঙ্গে যুক্ত হন চলচ্চিত্র সাংবাদিক রেনে জ্যানে ও ফ্রান্সের শিক্ষা মন্ত্রী জ্যঁ জায়। শুরু হয় উৎসবের জন্য উপযুক্ত শহর খোঁজার পালা। 

স্থান নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ছিল দুই কারণে। প্রথমত, এর আগে বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের গন্তব্য ছিল ইতালির ভেনিস। ভেনিস মানেই সৌন্দর্য আর জলে ভাসা শহর। সঙ্গে ইউরোপীয় ঐশ্বর্য। তাই নতুন উৎসব-কেন্দ্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রথম শর্তই ছিল স্থানটি হতে হবে ভেনিসের মতো মোহময় ও আকর্ষণীয়। দ্বিতীয়ত, যাঁরা উৎসবে অংশ নিতে আসবেন, তাঁরা সবাই বিশ্বের খ্যাতনামা অভিনেতা-অভিনেত্রী, পরিচালক ও প্রযোজক। বিলাসবহুল পরিবেশেই তাঁরা অভ্যস্ত। 

সবকিছু বিবেচনায় প্রথমেই পছন্দের তালিকায় উঠে আসে ফরাসি শহর বিয়ারিৎজের নাম। এটি আলিশান রিসোর্ট আর উচ্চবিত্তদের প্রিয় সাগরপাড়ের শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। উৎসবের জন্য শহরের পরিবেশ ছিল বেশ উপযুক্ত। তবে তখনই দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে আরেক প্রতিদ্বন্দ্বীর। সমুদ্র তীরের শান্ত অথচ অভিজাত শহর কানের।

কান শহর তখন যেন সিনেমার মঞ্চে নিজেই এক চরিত্র হয়ে ওঠার চেষ্টায় ছিল। নীল সমুদ্র আর বিলাসবহুল হোটেলগুলোর শহর কান প্রতিযোগিতায় বিয়ারিৎজকে হারিয়ে দেয় সবদিক থেকেই। এ সময় কান শহরের মানুষেরা ঘোষণাও দেন, উৎসবের জন্য তাঁরা দেবেন সবচেয়ে বেশি আর্থিক সহায়তা। এমনকি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল উৎসবের জন্য স্থায়ী ভবন নির্মাণেরও।

অন্যদিকে কানের ভৌগোলিক অবস্থানও তখনকার ইউরোপীয় বাস্তবতায় ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি ইতালির সীমান্ত থেকে তুলনামূলক দূরে আর রাজনৈতিকভাবেও নিরাপদ। আর আগে থেকেই পর্যটকদের আনাগোনা এ শহরে ছিল অনেক বেশি। এসব মিলিয়ে ১৯৩৯ সালের ৩১ মে ফরাসি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে কান-ই হতে যাচ্ছে সেই স্বপ্নের নতুন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজক শহর।

প্রথম কান চলচ্চিত্র উৎসবের স্বপ্ন থামিয়ে দিল বিশ্বযুদ্ধ

ইউরোপজুড়ে টান টান উত্তেজনা। বাতাসে বারুদের গন্ধ। তবু কানের আকাশে তখনো রৌদ্রোজ্জ্বল শান্তি। মিউনিসিপাল ক্যাসিনোর হল যেন স্বপ্নের মতো করে সাজানো হচ্ছিল এক ঐতিহাসিক যাত্রার জন্য। দিনক্ষণ নির্ধারিত, ১৯৩৯ সালের ১ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর হবে প্রথম কান চলচ্চিত্র উৎসব।

উৎসবের নীতিমালা ছিল সহজ। প্রতিটি দেশ পাঠাবে নিজের সেরা সিনেমা আর বিচারকেরা আসবেন বিভিন্ন দেশ থেকে। ফ্রান্স আমন্ত্রণ জানিয়েছিল জার্মানি আর ইতালিকেও। কিন্তু এই দুই দেশ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে। শেষপর্যন্ত মাত্র নয়টি দেশ রাজি হয় সিনেমা পাঠাতে, যদিও এই দেশগুলোই ছিল বিশ্ব চলচ্চিত্রের নামকরা প্রতিনিধি।

যুদ্ধ-পরিস্থিতিতেও উৎসবের প্রস্তুতি থেমে থাকেনি। ফরাসি শিল্পী জঁ-গ্যাব্রিয়েল দোমেরগ কান চলচ্চিত্র উৎসবের পোস্টার তৈরি করেছিলেন। এরপর দুই হাজার আমন্ত্রণপত্র ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীজুড়ে। এমনকি হলিউড থেকে তারকারা আসতে শুরু করলেন কানে। জাহাজ ভাড়া করে এসেছিলেন টাইরন পাওয়ার, গ্যারি কুপার, নর্মা শিয়্যারার ও মে ওয়েস্টের মতো বিখ্যাত তারকারা।

সবকিছু প্রস্তুত। শহর জ্বলজ্বল করছিল আলোয়। কিন্তু যেদিন উৎসব শুরু হওয়ার কথা, সেদিনই হিটলারের বাহিনী আক্রমণ চালায় পোল্যান্ডে। এ পরিস্থিতিতে পর্যটকেরা দ্রুত শহর ছাড়তে শুরু করল। তবুও আয়োজকেরা চেয়েছিলেন অন্তত একটি সিনেমার প্রাইভেট স্ক্রিনিং (প্রদর্শনী) হোক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দশ দিন পিছিয়ে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত এল। কিন্তু ১৯৩৯ সালের সেই উৎসবের আলো আর জ্বললো না। ঢাকা পড়ে গেল যুদ্ধের কালো ছায়ায়।

ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই আশার আলো, যুদ্ধশেষে কানের প্রথম আসর

১৯৪৫ সালের শেষার্ধ। ইউরোপ তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে ঠিকমতো মাথা তুলতেই পারেনি। ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো না। এমন অবস্থায় আবারও চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনের ভাবনা অনেকের চোখে অবাস্তব, এমনকি বিলাসিতাও বটে।

কিন্তু ফিলিপ এরলিঙ্গার হাল ছেড়ে দিলেন না। তিনি ১৯৩৯ সালের স্থগিত হয়ে যাওয়া সেই স্বপ্নের কান উৎসবকে আবার জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করলেন। শুরু করলেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অল্প অল্প করে চাঁদা তোলা।

অবশেষে ১৯৪৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নতুন আশার আলো নিয়ে পর্দা উঠল কানের প্রথম আসরের। তিন সপ্তাহের জন্য কান শহর যেন হয়ে উঠল বিশাল এক সিনেমাপাড়া। হলিউড থেকে হাজির হলেন বিখ্যাত সব তারকারা। যুদ্ধ শেষের ক্লান্তিকর পরিবেশকে সরিয়ে উৎসবে ফুটে উঠল উৎসাহ, উচ্ছ্বাস আর আনন্দ।

আয়োজকেরা যে উৎসবটিকে ভেবেছিলেন শুধুই সিনেমার মানুষের আড্ডা, মুহূর্তেই তা রূপ নেয় এক বিশাল জনসমাগমে। পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পাশাপাশি ভিড় করেন ইউরোপের অভিজাত ও কৌতূহলী শ্রেণির মানুষজনও। সব নিয়ম আর পরিকল্পনা ভেস্তে যায় জনস্রোতে।

এভাবেই দীর্ঘ ছয় বছরের যুদ্ধ শেষে কান চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথম আসর হয়ে দাঁড়ায় এক প্রতীকী প্রত্যাবর্তনের নাম, যেখানে আশাবাদ আর নতুন কান অধ্যায়ের শুরু।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment