কেন বারবার রাজপথে নামে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’
আজ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী। তারুণ্যের প্রতিবাদ ও বিদ্রোহে বারবার রসদ জোগান তিনি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান–সবখানেই এ কবির রচনাকে অবলম্বন করে এগিয়েছে জনতা। কেন বারবার রাজপথে নামে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’? লিখেছেন সৈকত আমীন
রাজপথে তখন বৃষ্টি পড়ছে না, কিন্তু আকাশটা ভার হয়ে আছে। ধোঁয়াটে, গোলাবারুদের গন্ধে মাখা শহরে কেউ কেউ চিৎকার উঠছে, ‘আমার ভাইকে মারলো কেনে?’ কেউ বলছে, ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত’। বাতাসে প্ল্যাকার্ড উড়ছে, আর ক্ষণিকের জন্য সেটার ছায়া পড়ছে কোনো তরুণের রক্তমাখা শার্টে, যার নাম আমরা জানি না। কিন্তু যার ছবি ভেসে বেড়ায় হাজারো মোবাইলের স্ক্রিনে।
এই দৃশ্য যদি কাজী নজরুল ইসলাম দেখতেন, তিনি নিশ্চয়ই থেমে যেতেন কিছুক্ষণের জন্য। থেমে গিয়ে হয়তো আবৃত্তি করতেন তাঁর নিজস্ব উচ্চারণে ‘আমি চির-বিদ্রোহী বীর–/ বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির।’
এই লাইন নজরুল যখন লিখেছিলেন, তখন ব্রিটিশ রাজ। শৃঙ্খল ছিল পরাধীনতার, গর্জন ছিল দাসত্ব ভাঙার। সময় বদলেছে। এখন শাসন নিজেরই হাতে, কিন্তু শোষণ বদলায়নি। শুধু শেকলের রং বদলেছে। ব্যারিকেডের ভাষা বদলেছে। তরুণদের চোখে ২০২৪ সালেও ছিল সেই লাল আগুন, যেটা ছিল ১৯২২ সালের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের রাস্তায় যা ঘটেছিল, তা কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনার ক্রম নয়। এটা ছিল এক সাংস্কৃতিক উত্থান, এক কবিতার বাস্তবায়ন। ছাত্র-তরুণেরা, যাদের জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশে, তারা হঠাৎ করেই বুঝে ফেলেছিল, ফ্যাসিস্ট শাসনে স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। তারা বুঝেছিল, রাজনীতিতে যখন হয়ে উঠেছে একই নাটকের পুনর্মঞ্চায়নে তখন ‘গণতন্ত্র’ শব্দটা একটা মিথ।
শুধু চাকরির কোটা নিয়ে নয়, এই বিক্ষোভ ছিল অসমতার বিরুদ্ধে, অসম্মানের বিরুদ্ধে আর অবজ্ঞার বিরুদ্ধে। যে ভাষায় শেখ হাসিনা তাদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলেছিলেন, সে ভাষা ছিঁড়ে ফেলেছিল একটি প্রজন্ম। নজরুলের মতো করেই তারা বলেছিল, ‘আমরা কেবল প্রশ্ন করবো না, আমরা ভেঙে ফেলবো ভদ্রতার মুখোশ।’
নজরুল যেমন বলেছিলেন, ‘আমি সেই যুগ-যুগান্তরের শপথভঙ্গ, আমি সে পথিক, কণ্টকাকীর্ণ পথে যে চলে নির্ভীক!’ এই বিক্ষোভ সেই পথিকের উত্তরাধিকারী। চোখে ছিল কান্না, কণ্ঠে ছিল বজ্র।
শহর আর মানুষের প্রতিচ্ছবি
তখন রাতেও শহর নিস্তব্ধ হতো না। কারফিউয়ের শহরে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ত সংবাদ, ‘ওই ছেলেটা গুলিতে মারা গেছে’, ‘ওর মা এখন হাসপাতালে’। এমন সব গল্প, যেগুলো ফেসবুকের অ্যালগরিদম ছাপিয়ে হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করে।
‘এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল!’
নজরুল গান গেয়েছিলেন শিকল ভাঙার। ঠিক তাই-ই করেছিল ২০২৪-এর বিদ্রোহীরা। ইন্টারনেট বন্ধ করে, গুলি চালিয়ে, ভয় দেখিয়ে আন্দোলন থামানো যায়নি। ছাত্রছাত্রীদের পোস্টারে ছিল নজরুলের কবিতা, গলায় ছিল তাঁর গান। কেউ গাইছিল, ‘কারার ঐ লৌহ কবাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট’। আবার কেউ লিখেছিল, ‘বিদ্রোহ এখন আমাদের জন্মাধিকার।’
এই গল্পগুলোর ভেতরে কাজ করত এক অবিনাশী চেতনা—নজরুলের বিদ্রোহ। যেখানে কোনো ভয় নেই, ভদ্রতা নেই, কেবল আকাঙ্ক্ষা সমতা ও সম্মানের।
যেমন নজরুল লিখেছিলেন, ‘আমি সেই গর্ব, আমি সেই অভিমান, আমি সেই অসহায় ক্রন্দন রোল!’ তাঁদের চোখে সেই অভিমান ছিল, যেটা কেবল অনন্ত লাঞ্ছনার পর জন্ম নেয়।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
যখন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলেন, শত শত শহীদের স্বজন তখন বুঝলেন, এই যাত্রা শেষ নয়। এইতো শুরু।
এক নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো। প্রধান হলেন মুহাম্মদ ইউনূস। পাণ্ডুলিপি বদলে যেতে লাগল। কিন্তু যে চেতনা মানুষের হৃদয়ে আগুন জ্বালিয়েছিল, সেটি আর মুছল না। তা হয়ে গেল গণচেতনার অংশ।
একজন মানুষ মিছিলে দাঁড়িয়ে নজরুলের কবিতা পড়লেন, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা!/ আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর।’ তারপর আবার গর্জে উঠল: ‘জুলাই বিপ্লব! বিদ্রোহের বাংলাদেশ!’ বুকটান করে আবারও নজরুলের শরণ নিলেন তাঁরা। শহরের দেয়ালে দেয়ালে লিখে দিলেন, ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, মোরা ঝরনার মতো চঞ্চল।’
২০২৫ সালে কেউ যদি লেখে এই আন্দোলনের গল্প, হয়তো সে বলবে, এটি একটি রাষ্ট্রের পাটাতন কেঁপে ওঠার গল্প। কিন্তু একজন সাহিত্যিক হিসেবে আমি বলি, এটি একটি কবিতার পুনর্জন্ম। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা যেখানে চিঠির মতো এসে পৌঁছেছিল এক প্রজন্মের হাতে—ছেঁড়া খামে, জ্বলন্ত শব্দে।
নজরুল একসময় লিখেছিলেন: ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ এই আন্দোলনে নারী-পুরুষ ও অন্যান্য লিঙ্গের সব মানুষই ছিল একসঙ্গে। এটি কেবল বিদ্রোহ নয়, এটি সম্মিলনের কবিতা।
যাঁরা বলেন, কবিতা কি রাজনীতি পাল্টাতে পারে? তাঁদের জন্য ইতিহাস বলবে, হ্যাঁ, একটি কবিতা পারত: এবং তা পেরেছে ২০২৪ সালের বর্ষায়। কাজী নজরুল ইসলামের কলমের আগুন আবার জ্বলেছে এ সময়ের তরুণদের চোখে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment