মধ্যপ্রাচ্যে নেতানিয়াহুকে যেভাবে ‘উপেক্ষা’ করছেন ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরে ইসরায়েলকে এড়িয়ে যাওয়া ও একাধিক কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত ইঙ্গিত দিচ্ছে, নেতানিয়াহুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ফাটল ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের নীতিতে ইসরায়েল আর আগের মতো অগ্রাধিকার পাচ্ছে না—যা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কৌশলগত বাস্তবতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন সৈকত আমীন
মধ্যপ্রাচ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সফর তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র ইসরায়েলের জন্য এক অস্বস্তিকর বার্তা নিয়ে এসেছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার সফর করলেও ট্রাম্প ইসরায়েলকে পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন। যা অনেকের কাছেই মনে হয়েছে ইসরায়েলের জন্য অপমানজনক। যদিও ইসরায়েলকে এড়িয়ে চলার বিষয়ে ট্রাম্প বলছেন ‘এটা ইসরায়েলের জন্যই ভালো’। তবে তাঁর মন্তব্যে আড়ালে বার্তা ছিল পরিষ্কার–ইসরায়েল এখন আর ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতির কেন্দ্রবিন্দু নয়।
ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো নেতানিয়াহুর জন্য একের পর এক ধাক্কা হয়ে এসেছে। যদিও প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প ইসরায়েলের জন্য একাধিক ঐতিহাসিক কাজ করেছিলেন। যেমন মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর, ইরান চুক্তি বাতিল, গোলান মালভূমি দখলের স্বীকৃতি ও আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ। তবে বর্তমান পরিস্থিতি একেবারে উল্টো।
ইরান চুক্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব
নেতানিয়াহুর অন্যতম প্রধান কূটনৈতিক নীতি ছিল ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান। অথচ এখন ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সঙ্গে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় বসেছে। এই আলোচনার সম্ভাব্য ফলাফল হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার বা ‘ইরান নীতিতে’ নমনীয়তা। যা নেতানিয়াহুর কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তিনি বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের আগের ইরান চুক্তির ঘোর বিরোধিতা করেছেন। এই পরিস্থিতি ইসরায়েলে ট্রাম্প সমর্থকদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
গাজা সংকটে মতপার্থক্য
গাজা পরিস্থিতিতেও স্পষ্ট মতানৈক্য দেখা দিয়েছে ট্রাম্প আর নেতানিয়াহুর। চলতি মাসে যুদ্ধ বিরতির মধ্যেই ইসরায়েল গাজায় নতুন করে আক্রমণ শুরু করে, যা ট্রাম্পের ভাষায় ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা’ গড়ে তোলার পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নেতানিয়াহু চাচ্ছেন হামাসের সম্পূর্ণ পরাজয়, কিন্তু ট্রাম্প তাঁর বিপরীতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তকে ইসরায়েল দেখে তাঁদের প্রতি মার্কিন সমর্থনের কমার লক্ষণ হিসেবে।
এদিকে ইসরায়েলি-আমেরিকান নাগরিক এডান আলেকজান্ডারকে হামাসের জিম্মিদশা থেকে মার্কিন প্রশাসন এককভাবে মুক্ত করে এনেছে। ইসরায়েলকে একবারের জন্যও যুক্ত না করেই। এ ঘটনায় চাপে পড়েছে নেতানিয়াহু। তাঁর সমালোচকরা বলছেন, নেতানিয়াহু এখনও জীবিত বাকি জিম্মিদের (প্রায় ২০ জন) মুক্ত করতে কার্যকর কিছু করতে পারেননি।
সিরিয়া ও হুথি সংকটে উপেক্ষা
সিরিয়া প্রসঙ্গেও নেতানিয়াহু ক্ষুব্ধ ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি। সৌদি সফরের সময় ট্রাম্প সিরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার সঙ্গে দেখা করেন। গত ২৫ বছরে এই প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট কোনো সিরিয়ান নেতার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ করলেন।
শুধু সাক্ষাৎ নয়, ট্রাম্প আহমেদ আল-শারারকে ‘আকর্ষণীয় ও অবিশ্বাস্য’ বলে অভিহিত করেন। একই সঙ্গে তুলে নেন তাঁর ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। এদিকে আল-শারার পূর্বের আল-কায়েদার সঙ্গে সংযোগের কারণে ইসরায়েল তাঁকে এক বিপজ্জনক শত্রু হিসেবে দেখে। তাঁর প্রতি নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার ইসরায়েলি অনুরোধে ট্রাম্প কান দেননি।
ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের অবহেলা লক্ষ্য করা গেছে ইসরাইলের প্রতি। গত গাজায় ৭ অক্টোবরের হামলার পর হুথিরা ইসরায়েল ও মার্কিন নৌবাহিনীকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে। প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র তাদের আক্রমণ করলেও, পরে হঠাৎ করেই ট্রাম্প প্রশাসন হুথিদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায়। ইসরায়েলকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে। যুদ্ধবিরতির মাত্র দুই দিন পর হুথিদের ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের প্রধান বিমানবন্দরে আঘাত হানে।
মধ্যপ্রাচ্যে মাতব্বরি থেকে সরে আসছে মার্কিনীরা?
ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, ট্রাম্প প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ‘মাতব্বারির’ ভূমিকা থেকে পিছিয়ে আসছে। জো বাইডেন আমলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সৈন্যদের ব্যাপক উপস্থিতি এবং কূটনৈতিক তৎপরতা ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যদিও যুদ্ধবিরতির জন্য চাপও ছিল। কিন্তু ট্রাম্প সিরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করছেন। তাঁর মন্ত্রিসভাও সাজিয়েছেন ‘বিদেশে হস্তক্ষেপ’-বিরোধী মনোভাবাপন্ন কর্মকর্তাদের দিয়ে। ইরানকে দমন, ইসলামিক স্টেটকে প্রতিহত এবং মধ্যপন্থী আরব দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতা রক্ষায় মার্কিন নেতৃত্ব ছিল ইসরায়েলের জন্য রক্ষাকবচ, যা এখন অনেকটাই নড়বড়ে।
সম্পর্ক ভাঙছে না, কিন্তু বদলাচ্ছে
এই সবকিছুর মধ্যেও ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এখনই ভেঙে পড়ছে না। ট্রাম্পের উপদেষ্টাদের অনেকেই ইসরায়েলের পক্ষে, কংগ্রেসের বেশিরভাগ রিপাবলিকানও তাই। গাজায় ট্রাম্পের মানবিক উদ্বেগের অভাব ইঙ্গিত দেয় যে তিনি সামরিক সমর্থন হঠাৎ বন্ধ করে দেবেন না। তিনি পশ্চিম তীরের বসতকারীদের ইসরায়েলিদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি ট্রাম্প সেখানে এমন একজন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেছেন (মাইক হাকাবি), যিনি ইসরায়েলের দখলদার নীতিকে সমর্থন করেন।
তবে এই সমর্থন নেতানিয়াহুর জন্য আশীর্বাদ না-ও হতে পারে। কারণ তাঁর চরম দক্ষিণপন্থী জোটসঙ্গীরা এখন আরও বড় দাবি তুলছে, যা সামলানো দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে নেতানিয়াহুর পক্ষে।
সব মিলিয়ে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে নেতানিয়াহুর জন্য সময়টা আর আগের মতো অনুকূল নয়। ট্রাম্প আগের যেকোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের তুলনায় অনেক বেশি ইসরায়েলের স্বার্থ উপেক্ষা করছেন। নিজের লক্ষ্য পূরণে মিত্র দেশের আপত্তিকেও পাত্তা দিচ্ছেন না। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ বন্ধই থাকবে, কিন্তু সেই মিত্রের আচরণ এখন এমন এক মধ্যপ্রাচ্য সৃষ্টি করছে, যা নেতানিয়াহুর জন্য হয়ে উঠছে ক্রমশ অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment