পহেলগামের কান্না, বলিউড কি আবারও ঘৃণা উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হবে
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগামে হামলার পর বলিউডকে সঙ্গে নিয়ে কি একপাক্ষিক বয়ান নির্মাণ করা হবে? এই হামলায় নিহত মানুষগুলো কি নিছকই রাজনীতির ঘুঁটি? লিখেছেন রাতুল আল আহমেদ
হল থেকে সিনেমা শেষে দর্শকেরা কাঁদতে কাঁদতে বের হচ্ছেন, এই দৃশ্য আমাদের অচেনা নয়। বলিউডের ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমার ক্ষেত্রে এমন দৃশ্যই দেখা গিয়েছিল। দর্শকদের কাঁদানোর জন্য প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছিল বিস্তর। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে সিনেমার টিকিটের কর মওকুফ করা হয়েছিল। কোথাও কোথাও ব্যবস্থা করা হয়েছিল আধবেলা ছুটিও, যাতে সরকারি কর্মচারীরা সিনেমাটি দেখতে পারে। এমনকি স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও সিনেমাটির প্রশংসা করেন।
এত সব আয়োজন যে এই প্রথম, তা কিন্তু নয়। এর আগে ২০১৯ সালে, ‘উরি: দ্য সার্জিকাল স্ট্রাইক’ চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা ভারতের ১৭তম লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে ৩ শরও বেশি আসনে জিতে আসতে সাহায্য করেছিল। ফলে সাদা চোখে চলচ্চিত্রকে কেবল বিনোদনমাধ্যম মনে হলেও আদতে তা হয়ে উঠছে সম্মতি উৎপাদনের হাতিয়ার।
২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপির ভূমিধ্বস বিজয়ের পেছনে কাশ্মীরের হাত থাকলেও সরকার গঠনের পর কাশ্মীরকে বেশ ভালো খেসারত দিতে হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার আইনসভায় বিল পাশ করে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের ৩৭০ ধারাকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে।
এছাড়া ভারত শাসিত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটিকে ভেঙে দুইটি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি করা হয়। একটি হলো জম্মু ও কাশ্মীর এবং অপরটি লাদাখ। বৌদ্ধপ্রধান অঞ্চল লাদাখ, যা ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীর রাজ্যের অংশ ছিল, তাকে কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। এই পদক্ষেপের ফলে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা এবং প্রশাসনিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় বিজেপির স্লোগান ছিল ‘অব কি বার চারসো পার’ (এবার হবে ৪০০ পার)। রামমন্দির নির্মাণ, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা রদ, নাগরিকত্ব সংশোধন আইন প্রণয়নের মতো উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ডের পর বিজেপি আত্মবিশ্বাসী ছিল এবার তারা ৪ শর বেশি লোকসভা আসনে জিতবে। নির্বাচনী ফলাফল তাঁদের এই অতি-আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরায়। জোট সরকার গঠন করতে হয় বিজেপিকে।
অনেকের মতে, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি বরাবরই ঘৃণাকে পুঁজি করে রাজনীতি করে এসেছে। ঘৃণা উৎপাদনের জন্য তাই তাকে সবসময়ই একটি ‘অপর’ বা ‘কল্পিত শত্রু’র খোঁজে থাকতে হয়। এই ‘কল্পিত শত্রু’ নির্মাণে বলিউড বেশ সচেতনভাবে অংশগ্রহণ করেছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’, ‘দ্য কেরালা স্টোরি’, বা ‘ছাভা’—এই চলচ্চিত্রগুলো ভারতীয় হিন্দুদের সামনে যাদেরকে ‘অপর’ করে তুলছে, তারা প্রধানত মুসলমান সম্প্রদায়। অবশ্য এসব ছবির নির্মাতাদের দাবি এগুলো সত্য ঘটনা অবলম্বনে বা ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। তবে চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের ভাষ্য, এগুলো ‘প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্র’। ২০২২ সালের ভারতের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (আইএফএফআই)-এর প্রধান জুরি নাদাভ লাপিড ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ চলচ্চিত্রটিকে ‘অশ্লীল প্রপাগান্ডা’ বলে অভিহিত করেন। সিনেমাটি প্রতিযোগিতা বিভাগে মনোনীত হতে দেখে তিনি ‘হতবাক’ হয়েছেন বলে জানান। প্রসঙ্গত, ভারতের জাতীয় সংহতি, সামাজিক ঐক্য এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রচারে সেরা জাতীয় চলচ্চিত্রের তকমা জুটেছিল সেই বছর কাশ্মীর ফাইলসের বরাতে।
২০২৬ সালে ভারতের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। একইসঙ্গে আগামী লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরেও এখন থেকেই সম্মতি উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু করেছে ক্ষমতাসীন বিজেপি, এমন বলছেন বিশ্লেষকরা। ঠিক এই বাস্তবতায় ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগামের বৈসরণ উপত্যকায় সশস্ত্র হামলা হলো। উরি বা পুলওয়ামায় হামলা হওয়ার পর পরই বলিউডকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপি যেভাবে একপাক্ষিক বয়ান নির্মাণ করেছিল, পহেলগামের হামলার পরেও কি তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে? হামলায় নিহত মানুষগুলো কি নিছকই রাজনীতির ঘুঁটি?
পহেলগাম হামলার পরে সম্ভাব্য যা ঘটবে, বিজেপির বিগত বছরের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে তার একটা আভাস পাওয়া যেতে পারে—উগ্র জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়ে যাবে বলিউডে। থাকবে সহজ-সরল কিছু মানুষ, তার বিপরীতে খলনায়ক হিসেবে থাকবে সুরমা চোখের একদল মুসলমান, যারা ধর্মীয় স্লোগান দিতে দিতে এই মানুষদের নৃশংসভাবে হত্যা করবে। এর সঙ্গে ‘টোকেন’ হিসেবে থাকবেন একজন ‘ভালো’ মুসলমানও, যিনি ‘পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের’ বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে প্রাণত্যাগ করবেন। তবে চলচ্চিত্রের নায়ক থাকবেন একজন উত্তর ভারতীয় হিন্দু পুরুষ, শেষদৃশ্যে যার মর্মান্তিক মৃত্যু দর্শককে কাঁদতে বাধ্য করবে। সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে দর্শকদের হাত নিশপিশ করবে এই কল্পিত শত্রুকে খতম করার জন্য। কিন্তু হায়! কোথায় সেই ‘অপর’, কোথায় সেই কল্পিত শত্রু! অগত্যা ঝাল ঝাড়া হবে বাস্তবের সাধারণ মুসলমানদের ওপর।
ফরাসী দার্শনিক লুই আলথুসার তাঁর বিখ্যাত ‘আদর্শ ও আদর্শবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র’ প্রবন্ধে রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে কেবল বন্দুকের জোরে বা জবরদস্তির মাধ্যমে নয়, বরং জনগণের মধ্যে একটি ‘আদর্শের’ ধারণা গড়ে তুলে মনোজগত শাসন করে, তা ব্যাখ্যা করেন। যার প্রমাণ দেখা গেল পহেলগামে হামলার পর পরই ভারতের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মুসলমানদের ওপর হামলার খবরে। কোথাও কাশ্মীরী শিক্ষার্থীদের ভাড়া বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া বা অন্ত্বসত্ত্বা মুসলমান নারীকে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করার সংবাদও পাওয়া গেছে। রাষ্ট্রযন্ত্র মুসলমানদের জাতীয় শত্রু নির্মাণের যে প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত রয়েছে, তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এসব সংবাদের মাধ্যমে।
কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘তুমি মানুষকে ভালোবাসো না, অথচ দেশকে ভালোবাসো কেন?’ এই প্রশ্ন আজ খুব প্রাসঙ্গিক ভারতের রাজনীতিতে। বিজেপি ও আরএসএস যেভাবে ভারতের সমাজকে মুসলমানবিদ্বেষের মাধ্যমে উগ্র হিন্দুত্ববাদী গড়ে তুলছে, সেখানে সাধারণ মানুষ কোথায়? ক্রমাগত শত্রু নির্মাণ করতে করতে ভারতীয় সমাজ কি আরও একাকী, অমানবিক, সহানুভূতিহীন হয়ে উঠবে? আর বলিউড কি সেই সমাজ তৈরির কারখানা হয়েই রইবে?
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment