×

কতদিন আমাদের এভাবে পালিয়ে বেড়াতে হবে, প্রশ্ন কাশ্মীরবাসীর

গত ২২ এপ্রিল পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসীদের হামলার পর এক আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর। ভারত-পাকিস্তানের সংঘাতের জেরে সেখানে অনেকেই হয়েছেন বাস্তুচ্যুত। তাঁদের নির্মম অভিজ্ঞতার গল্প দ্য নিউজ লন্ড্রির প্রতিবেদন অবলম্বনে লিখেছেন শতাব্দীকা ঊর্মি।

১১ মে, সকাল। ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের একটি ত্রাণ শিবিরের এক কর্মকর্তা জানান, নিরাপত্তার স্বার্থে আগামী তিন থেকে চার দিন কাউকে শিবির ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে না। এটি প্রশাসনের পক্ষ থেকে কড়া নির্দেশ।

এমন নির্দেশনায় আশ্রয় শিবিরের সবার বুক কেঁপে ওঠে। এই শিবিরের বাসিন্দারের কয়েকদিন আগেও ঘর ছিল, সুন্দর সংসার ছিল। এখন তাদের পরিচয় ‘উদ্বাস্ত’। প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন এই শিবিরে।

ঘটনার সূত্রপাত গত ২২ এপ্রিল। কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হন। এ হামলার জন্য পাকিস্তানকে সরাসরি দায়ী করে ভারত। পাকিস্তান স্পষ্টভাবে এই অভিযোগ প্রত্যাখান করে। তারপরও ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিন্ধু নদের পানিচুক্তি স্থগিত করাসহ একের পর এক পদক্ষেপ নিতে থাকে। পাকিস্তানও ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেয়। দুই দেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। যেকোনো সময় দুই দেশের মধ্যে শুরু হয়ে যেতে পারে যুদ্ধ।

শেষ পর্যন্ত আশঙ্কাই সত্যি হয়। ৭ মে ‘অপরেশন সিঁদুর’ নাম দিয়ে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর ও এর আশপাশের এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত। এতে অন্তত ১৮ জন নিহত এবং ৬০ জনের বেশি আহত হন। এরপর পাকিস্তানও ‘অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস’ নামে হামলা চালায় ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে। হতাহত হয় অনেকেই।

পেহেলগামের পারগওয়ালের বাসিন্দা শকুন্তলা দেবী। ৭৩ বছরের দুর্বল পা নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে নাতি কূলদীপ সিংহের হাত ধরে ছুটে যান আশ্রয়শিবিরে। তিনি বলেন, ‘এই প্রথম নয়, ১৯৭১ সালেও যখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়, তখনও আমি বাস্তুচ্যুত হয়েছিলাম। কিন্তু এবারের মতো এতটা ভয় কখনোই পাইনি।’

বর্তমানে জম্মু জেলায় ১৩টি ত্রাণশিবির খোলা হয়েছে। প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। শিবিরে নারী-পুরুষদের আলাদা করে রাখা হয়েছে। তাদের জন্য অস্থায়ী বিছানা, খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশ, আগামী কয়েকদিন কেউই নিজেদের বাড়িতে ফিরতে পারবে না। কারণ এখনও বহু গোলা-বারুদের ঝুঁকি রয়েছে

পারগওয়ালের আরেক বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী বলবন্ত সিংহ বলেন, ‘আমরা ফসল ঘরে তোলার পরপরই সব কিছু ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছি। বাঙ্কারগুলো সারা বছর পানিতে ভরা থাকে, সেখানে আশ্রয় নেওয়া সম্ভব নয়। আমরা শুধু প্রার্থনা করেই বাঁচি।’ তবে তাঁর ভাই প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই পশুপালনের দায়িত্বে গ্রামেই রয়ে গেছেন।

অন্যদিকে গারখাল এলাকার এক ত্রাণ শিবিরে বিহারের প্রায় ১২০ জন অভিবাসী শ্রমিক রয়েছেন। তাঁরা স্থানীয় জমির মালিকদের ক্ষেতে কাজ করতেন। ক্যাম্পে স্থানীয়দের সঙ্গে তাঁদের খাদ্য নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়েছে।

কুড়ি বছর বয়সী মুন্না কুমার অভিযোগ করেন, ‘স্থানীয়রা চারটি রুটি নেয়, আমাদের দেয় মাত্র দুটি। এখানে আমরা না পারছি খেতে, না পারছি ফিরতে।’ তিনি জানান, তাঁর স্ত্রী, শিশু সন্তান ও ভাই নিয়ে তিনি ক্যাম্পে আটকে রয়েছেন।

প্রতিশ্রুতি থাকলেও তাঁদের বিহারে ফেরানোর কোনো ব্যবস্থা এখনো হয়নি। শ্রমিক প্রীতি দেবী বলেন, ‘আমার ২০ হাজার টাকা পাওনা রয়ে গেছে। এখন চলে গেলে সেই টাকা আর পাওয়া যাবে না।’

গত ১০ মে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয় ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরেও সীমান্তবাসীদের অনিশ্চয়তা কাটেনি। এই বাস্তবতা তাঁদের মনে প্রশ্ন তোলে—কতদিন এভাবে পালিয়ে বেড়াতে হবে?

এই কঠিন বাস্তবতায় স্থায়ী নিরাপত্তার দাবি আজ আরও জোরালো হয়ে উঠছে।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment