ইসরায়েলের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্য
গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান ও বেসামরিক জনগণের ওপর ব্যাপক সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের সঙ্গে নতুন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্য। পাশাপাশি পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপন ও সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে লন্ডন।
আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি বোমা হামলায় গাজায় গত কয়েকদিনে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। অঞ্চলটিতে শুরু হওয়া নতুন স্থল অভিযান ও টানা অবরোধের ফলে বহু মানুষ অনাহারে আজ মৃত্যুর মুখোমুখি। এ সব কারণে যুক্তরাজ্যের এই কঠোর সিদ্ধান্ত।
মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেন, ‘ইসরায়েলি সরকারের দায়িত্ব হলো এই আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা এবং হস্তক্ষেপ করা। কার্যকর ও ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিতে তাঁদের ব্যর্থতা ফিলিস্তিনি সম্প্রদায় এবং দুই রাষ্ট্রের সম্ভাব্য সমাধানকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।’ তিনি আরও জানান, যুক্তরাজ্য নতুন করে তিনজন ব্যক্তি, দুইটি অবৈধ বসতি এবং সহিংসতায় সহায়তাকারী দুই সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
এ ছাড়া লন্ডনে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত টিপি হোতোভেলিকে পররাষ্ট্র দপ্তরে ডেকে কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও জানান, ‘ইসরায়েলের বর্তমান নীতিমালার আলোকে যুক্তরাজ্য কোনো নতুন বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা শুরু করতে পারে না। তবে, পূর্ববর্তী চুক্তি এখনো কার্যকর রয়েছে।’
আল-জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজায় ১১ সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে খাদ্য ও ওষুধ প্রবেশ করতে না দেওয়ায় ৩২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেক শিশুও আছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা প্রধান সতর্ক করে বলেছেন, সহায়তা প্রবেশ না করলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ১৪,০০০ শিশু মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়বে।
ইসরায়েল ইতোমধ্যে দক্ষিণ গাজায় “গিডিওন্স চারিয়টস” নামের নতুন স্থল অভিযান শুরু করেছে। এই অভিযান আরও সহিংসতা, বাস্তুচ্যুতি এবং প্রাণহানি বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে আল-জাজিরা।
ইইউ’রও পদক্ষেপ
যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ইইউ’র পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কায়া কাল্লাস বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের বিদ্যমান ‘ইইউ-ইসরায়েল অ্যাসোসিয়েশন চুক্তি’ পর্যালোচনা করা হবে। ইইউর ২৭ দেশের মধ্যে ১৭টি সদস্য রাষ্ট্র এই প্রস্তাব সমর্থন করেছে।
কাল্লাস আরও বলেন, ‘ইসরায়েল যতটুকু সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় একফোঁটা মাত্র। দ্রুত, অবাধ ও পর্যাপ্ত সহায়তা প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে।’
ইসরায়েলের পাল্টা প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তরাজ্যের বসতি স্থাপনকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞাকে ‘বিভ্রান্তিকর, ভিত্তিহীন ও অনভিপ্রেত’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, দেশের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষায় যেসব শক্তি ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও সে অবস্থান থেকে পিছু হটবে না।
বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘যদি যুক্তরাজ্য ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব ও নিজেদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে নিজ অর্থনীতির ক্ষতি করতে চায়, তবে তা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত।’ এই সিদ্ধান্তের পর ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘নিষেধাজ্ঞা অযৌক্তিক এবং দুঃখজনক। এমনিতেই যুক্তরাজ্য আলোচনায় আগ্রহ দেখাচ্ছিল না, এখন তারা তা স্থগিত বলছে।’
অস্ত্র রপ্তানি ইস্যুতে সমালোচনা
যুক্তরাজ্য সরকার কিছু অস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স স্থগিত করলেও, এফ-থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমান প্রকল্পের মতো কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রেখেছে। ব্রিটিশ সরকারের নিজস্ব পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ আংশিক স্থগিতাদেশ কার্যকর হওয়ার পরেও দেশটি ৮,৬৩০টি পৃথক গোলাবারুদ ইসরায়েলে পাঠিয়েছে।
ফিলিস্তিনি যুব আন্দোলন, প্রগ্রেসিভ ইন্টারন্যাশনাল এবং ‘ওয়ার্কার্স ফর এ ফ্রি প্যালেস্টাইন’ নামের তিনটি সংগঠনের এক বিবৃতিতে বলা হয়, নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পরও যুক্তরাজ্য ইসরায়েলে ৮ হাজার ৬৩০টি পৃথক গোলাবারুদ পাঠায়।
যুক্তরাজ্য সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আংশিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে দেশটি ১২৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন পাউন্ড, অর্থাৎ প্রায় ১৭১ মিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র রপ্তানির অনুমোদন দেয়
এই তথ্য উঠে এসেছে আল-জাজিরার একটি গবেষণা প্রতিবেদন এবং সরকারি নথি থেকে।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সমালোচনা
সরকারের এমন সব পদক্ষেপের পরেও তাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। লেবার দলের এমপি জারা সুলতানা বলেন, ‘পরিবার ও মহল্লা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি সংগঠিত শাস্তিমূলক অভিযান। আর সরকারের নীরবতা কেবল নৈতিক নয়, রাজনৈতিক ব্যর্থতা।’
সাবেক লেবার নেতা ও বর্তমান স্বাধীন এমপি জেরেমি করবিন বলেন, ‘সরকার যদি গণহত্যার দায় এড়াতে চায়, তাহলে ইসরায়েলের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বন্ধ করে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে।’
এ ছাড়া দেশজুড়ে অনেক মানুষ প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিচ্ছে এবং ফিলিস্তিনের সমর্থনে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে আরও জোরালো অবস্থান দাবি করছে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment