×

সাহিত্যিক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো মারা গেছেন

স্ট্রিম ডেস্ক
কেনিয়ান সাহিত্যিক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক প্রতিবাদে ভূমিকা তাঁকে আফ্রিকার সাহিত্য আন্দোলনের অগ্রপথিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। খবর বিবিসি

স্থানীয় সময় ২৮ মে  যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার বেডফোর্ডে মৃত্যুবরণ করা নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর সংবাদ জানাতে গিয়ে তাঁর সন্তান ওয়ানজিকু ওয়া থিয়োঙ্গো বলেন, ‘ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানাচ্ছি যে আজ বুধবার সকালে আমাদের বাবা নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো মারা গেছেন।’

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর মৃত্যুতে বিবিসি লিখেছে, তিনি ছিলেন আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের এক মহীরুহ, যিনি কারাবাস, নির্বাসন ও রোগ-ব্যাধির বেড়াজাল উপেক্ষা করে গল্প বলার সাধনায় অটল ছিলেন।

প্রায় ছয় দশকজুড়ে সাহিত্যচর্চা করেছেন কিকুয়ু ভাষার এই লেখক। নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো লেখায় বারবার উঠে এসেছে উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা-উত্তর কেনিয়ার রূপান্তরের চিত্র। উপনিবেশবাদ, ভাষা, পরিচয় ও শ্রেণিবৈষম্যের মতো বিষয়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপসহীন।

অনেকবারই নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম আলোচনায় এসেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই স্বীকৃতি পাননি। তবু তাঁকে নোবেলযোগ্য সাহিত্যিক হিসেবেই মনে করেন অনেকে।

১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশাধীন কেনিয়ার লিমুরু শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর আসল নাম ছিল জেমস থিয়োঙ্গো নগুগি । কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠা নগুগি অ্যালায়েন্স হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। এই স্কুলে পড়ার সময়ই উপনিবেশিক দমন-পীড়নের সরাসরি শিকার হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতাও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি। ১৯৫০-এর দশকে মাউ মাউ বিদ্রোহের সময় তাঁর গ্রাম পুড়িয়ে দেয় উপনিবেশিক প্রশাসন। তাঁর এক ভাই, যিনি ছিলেন বধির, তাঁকে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করে ব্রিটিশ সেনারা। এসব ঘটনা এনগুগির রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক অবস্থানের ভিত্তি গড়ে দেয়।

পরে নগুগি উগান্ডার মেকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং সেখানেই বিখ্যাত নাইজেরীয় লেখক চিনুয়া আচেবের সহায়তায় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘উইপ নট, চাইল্ড (১৯৬৪) প্রকাশিত হয়। এটি ছিল পূর্ব আফ্রিকার প্রথম উল্লেখযোগ্য ইংরেজি ভাষার উপন্যাস। যা পরে বাংলা ভাষাতেও ‘কেঁদো, না বাছা’ নামে অনুদিত হয়।

এরপর ‘দ্য রিভার বিটুইন, ‘আ গ্রেইন অব হুইট’, ‘পেট্যালস অব ব্লাড’ ইত্যাদি উপন্যাসের মাধ্যমে আফ্রিকান সাহিত্যে নগুগির স্থান আরও সুদৃঢ় হয়।

১৯৭৭ সালে নগুগি নিজের ইংরেজি নাম ‘জেমস’ পরিত্যাগ করে গ্রহণ করেন নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো নামটি এবং সিদ্ধান্ত নেন আর ইংরেজিতে লিখবেন না—শুধু মাতৃভাষা কিকুয়ুতে সাহিত্য করবেন। সেই বছরই তিনি কিকুয়ু ভাষায় নাটক ‘নগাহিকা নদেন্দা’ (আমি যখন ইচ্ছা বিয়ে করব) মঞ্চস্থ করেন, যা সরকারের রোষানলে পড়ে। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তিনি এক বছর জেলে খাটেন। জেলে বসেই টয়লেট পেপারে লেখা তাঁর প্রথম কিকুয়ু ভাষার উপন্যাস ‘ডেভিল অন দ্য ক্রস’ লেখেন।

পরবর্তীতে রাজনৈতিক চাপে তিনি যুক্তরাজ্য ও পরে যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান নগুগি। দীর্ঘ ২২ বছর পর দেশে ফিরে তিনি গণসংবর্ধনা পেলেও, তাঁর বাসভবনে এক নৃশংস হামলায় তিনি ও তাঁর স্ত্রী আক্রান্ত হন। তখন তিনি এই ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে মন্তব্য করেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে ইয়েল, নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন এনগুগি।

নগুগির বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’ যা বাংলাসহ অসংখ্য ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। বিউপনিবেশবাদী সাহিত্যের অন্যতম সেরা কাজ হিসেবে এই বইকে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি পড়ানো হয়ে থাকে।

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো শেষজীবনে ক্যানসার, হৃদরোগ ও কিডনির সমস্যায় ভুগেছেন তিনি। ২০১৯ সালে তাঁর বাইপাস সার্জারি হয়, এর আগে ১৯৯৫ সালে প্রোস্টেট ক্যানসার ধরা পড়লেও চিকিৎসায় সুস্থ হন।

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর মৃত্যুতে আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্য এক মহীরুহ সাহিত্য হারাল, হারাল এক নির্ভীক কণ্ঠস্বরকে, যিনি ভাষা ও সাহিত্যের মধ্য দিয়ে শোষণের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন।

 

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment