আলুর অর্থনীতি: বগুড়া ও জয়পুরহাটে দামের ধস, কৃষকের সংকট ও সমাধানের পথ
মো. তৌফিকুল ইসলাম
বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে আলু একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য ও নগদ অর্থকরী ফসল। প্রতি বছর দেশের আলু উৎপাদনের একটি বড় অংশ আসে উত্তরাঞ্চলের বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলা থেকে। কিন্তু ২০২৫ সালের শুরু থেকে এই অঞ্চলের কৃষকরা নজিরবিহীন দামের পতনে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এমন বাস্তবতায় আলু অর্থনীতিকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ ও পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে।
আলুর ‘বাম্পার হারভেস্ট ও তার খেসারত
বর্তমান মৌসুমে (২০২৪–২৫) বাংলাদেশে মোট আলু উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ মেট্রিক টন, যা বিগত ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। শুধু বগুড়া জেলাতেই উৎপাদন হয়েছে প্রায় ২২ লাখ মেট্রিক টন, আর জয়পুরহাটে ৮.৫ লাখ মেট্রিক টন (সূত্র: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর)। এই দুই জেলা মিলেই দেশের মোট আলু উৎপাদনের প্রায় ২৬–২৮% যোগান দেয়।
বাম্পার ফলন সত্ত্বেও এই বিশাল উৎপাদনের বিপরীতে পর্যাপ্ত সংরক্ষণ সুবিধা, বিপণন নীতি ও চাহিদার ঘাটতি থাকায় বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ সৃষ্টি হয়েছে। ফলাফল—কৃষক পর্যায়ে আলুর দাম কমে দাঁড়িয়েছে ৫–৮ টাকা/কেজি, যেখানে উৎপাদন খরচ ছিল ১২–১৪ টাকা/কেজি। অর্থাৎ কৃষকরা প্রতি কেজিতে ৪–৬ টাকা লোকসান গুনছেন।
পরিকল্পনার ঘাটতি না সিন্ডিকেটের খেলা?
দামের পতনের পেছনে একাধিক কাঠামোগত ও বাজারভিত্তিক কারণ আছে:
অতিরিক্ত উৎপাদন বনাম চাহিদার ব্যবধান
দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৮৫–৯০ লাখ মেট্রিক টন, যার মধ্যে প্রায় ৭৫–৮০% অভ্যন্তরীণ খাদ্য চাহিদা পূরণে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এবারের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন বেশি হয়েছে। এই উদ্বৃত্ত চাহিদার অভাবে বাজারে সঠিক মূল্য পাওয়া যাচ্ছে না।
কোল্ড স্টোরেজের সীমাবদ্ধতা
বর্তমানে দেশে মোট ৪৩০টির মতো কোল্ড স্টোরেজ আছে, যার অধিকাংশই বেসরকারিভাবে পরিচালিত। এগুলোর সম্মিলিত ধারণক্ষমতা প্রায় ৫৭–৬০ লাখ মেট্রিক টন। এর মানে হলো, উৎপাদিত আলুর ৫০%-৫৫% এর বেশি হিমাগারে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। বাকি আলু কৃষক বাধ্য হয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হন।
সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগী কর্তৃত্ব
আড়তদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেট অনেক জেলায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। কৃষকরা সরাসরি বাজারে পণ্য বিক্রি করতে পারেন না। ফড়িয়ারা কম দামে আলু কিনে উচ্চ দামে বিক্রি করেন। এর ফলে কৃষকরা প্রকৃত দাম পান না।
নিরীক্ষাহীন রপ্তানি নীতি ও অবকাঠামো দুর্বলতা
বাংলাদেশ ২০২৩–২৪ অর্থবছরে মাত্র ১.৮ লাখ মেট্রিক টন আলু রপ্তানি করেছে (বাণিজ্য মন্ত্রণালয়)। অথচ প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে বাংলাদেশি আলুর ভালো চাহিদা রয়েছে। মানসম্পন্ন প্যাকেজিং, কোল্ড চেইন পরিবহন ও সরকারি সহায়তার অভাবে সেই সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি।
সংখ্যা বলছে কী?
একটি বিঘা জমিতে আলু উৎপাদনে খরচ হয় গড়ে ৩৫,০০০–৪০,০০০ টাকা, যেখানে ফলন হয় প্রায় ৮০–১০০ মণ। বর্তমান বাজার দরে এই পরিমাণ আলু বিক্রি করে পাওয়া যাচ্ছে গড়ে ২৫,০০০–২৮,০০০ টাকা। অর্থাৎ একজন কৃষক প্রতি বিঘায় কমপক্ষে ৮,০০০–১২,০০০ টাকা লোকসান গুনছেন।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭২% কৃষকই আলু বিক্রি করে তাদের উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না। তাছাড়া, অনেক কৃষক ব্যাংক বা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে চাষ করেন। এখন সেই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় তারা আইনি ও সামাজিক চাপের মুখে পড়ছেন।
সম্ভাব্য সমাধান ও নীতিগত প্রস্তাবনা
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কিছু বাস্তবভিত্তিক সুপারিশ তুলে ধরা হলো:
নূন্যতম মূল্য নির্ধারণ ও সরকারি সরাসরি ক্রয়
সরকারকে ১২–১৪ টাকা কেজি দরে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে আলু কেনার ব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্য অধিদপ্তর বা বিপণন অধিদপ্তর এ কাজ করতে পারে। এতে বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে এবং কৃষক কিছুটা আশ্বস্ত হবেন।
রপ্তানি বাড়াতে প্রণোদনা ও সহজতর নীতি
রপ্তানির জন্য মান নিয়ন্ত্রণ, হিমায়িত পরিবহন ও রপ্তানিকারকদের ২০% প্রণোদনা প্রদান করলে ২০২৫–২৬ সালে রপ্তানি ৫ লাখ মেট্রিক টন–এ উন্নীত করা সম্ভব।
ডিজিটাল কৃষক বাজার গড়ে তোলা
সরকারি উদ্যোগে প্রতিটি উপজেলায় ‘কৃষক বাজার অ্যাপ’ চালু করে কৃষক ও ক্রেতার মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করা যেতে পারে। এতে দালালদের দৌরাত্ম্য কমবে।
কোল্ড স্টোরেজ সম্প্রসারণ ও ভর্তুকি
নতুন হিমাগার স্থাপনে ৫০% সরকারি ভর্তুকি এবং কৃষকদের জন্য সংরক্ষণ ফি ৫০% কমিয়ে আনলে অনেক কৃষক সংরক্ষণে আগ্রহী হবেন।
ফসল বিমা চালু ও ঋণ পুনঃতফসিল
প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফসল বিমা চালু করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ঋণ পুনঃতফসিল করে সুদ মওকুফ করা জরুরি।
স্বপ্ন বাঁচাতে বাস্তব পদক্ষেপ জরুরি
আলু বাংলাদেশের জন্য শুধু একটি ফসল নয়—এটি লাখো কৃষকের জীবিকার উৎস, সন্তানের ভবিষ্যতের স্বপ্ন। বগুড়া ও জয়পুরহাটের মতো অঞ্চলগুলোতে কৃষকেরা যখন দাম না পেয়ে ভেঙে পড়েন, তখন তা দেশের সার্বিক অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলে।এই সংকট মোকাবেলায় এখন আর বক্তৃতা নয়, বাস্তব পদক্ষেপ প্রয়োজন। নীতিনির্ধারকদের পরিকল্পনায় কৃষকের স্বপ্নের প্রতিফলন থাকতে হবে, তাহলেই সত্যিকারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
লেখক:
মো. তৌফিকুল ইসলাম
ম্যানেজার (এসপিও),রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, আলিরহাট শাখা, বগুড়া (উত্তর)
ইমেইল: tawfiqul1983@gmail.com
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment