×

‘তৌহিদী জনতা’ কি এই বাংলায় নতুন কিছু?

রাতুল আল আহমেদ
দিনাজপুরের হিলিতে বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে গত ২৮ জানুয়ারি স্থানীয় মাঠে প্রমিলা ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছিল বাওনা ছাত্র কল্যাণ পরিষদ। খেলার আগে তারা মাইকিং করে প্রচারও করেছিল টুর্নামেন্ট আয়োজনের। টিকিটও বিক্রি হয়।
বিপত্তি বাঁধে খেলা শুরু হওয়ার আগে। ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে একদল মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধের দাবি জানায়। এই নিয়ে আয়োজক কমিটির সঙ্গে তাদের উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে প্রশাসনের উপস্থিতিতেই তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং টুর্নামেন্ট ভণ্ডুল হয়ে যায়। পরবর্তীতে এই ফুটবল টুর্নামেন্ট নিয়ে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রশাসনের সহায়তায় গত ৬ ফেব্রুয়ারি টুর্নামেন্টটি পুনরায় অনুষ্ঠিত হয়।
২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে ‘তৌহিদী জনতা’দের এমন কার্যকলাপ এটিই প্রথম বা একমাত্র নয়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ধর্মীয়-সামাজিক পরিসরে ‌’তৌহিদী জনতা’ নামটি বিশেষভাবে উচ্চারিত হচ্ছে।
এই নামের পেছনে যে ধর্মীয় শব্দ ‘তাওহীদ’, তার তাৎপর্য, ব্যাখ্যা ও ব্যবহার ইতিহাসের বহু পরম্পরা বহন করে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা তাওহীদ শব্দটির আধ্যাত্মিক মর্মার্থ, সুফি দর্শনের প্রভাব, এবং বাংলাদেশের সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে ‘তৌহিদী জনতা’ নামে পরিচিত একটি গোষ্ঠীর কার্যক্রম ও অবস্থান বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
যেভাবে এল ‘তৌহিদি জনতা’ 
‘তৌহিদি জনতা’ শব্দবন্ধটি আরবি ‘তাওহীদ’ ও বাংলা ‘জনতা’ এই দুই শব্দের সমন্বয়ে তিরি। আরবি শব্দ ‘তাওহীদ’ মূলত এসেছে ‘ওহাদা’ ধাতু থেকে, যার অর্থ এক করা। ইসলামী বিশ্বাসে এর অর্থ আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস রাখা। এটি ইসলামের মৌলিক ভিত্তি, যা একজন মুসলমানের চিন্তা, আচরণ এবং নৈতিকতার কেন্দ্রবিন্দু গঠন করে। এই তত্ত্ব ইসলামী দর্শনে আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছু বা কাউকে শরিক না করার ওপর গুরুত্বারোপ করে এবং তা ইসলামি সমাজের মূল্যবোধ, আইন, ও সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত।
অন্যদিকে ইসলামের আধ্যাত্মিক ধারার একটি অংশ ‘তাসাউফ’ বা সুফিবাদ, যেখানে তাওহীদকে শুধু বিশ্বাসের বিষয় হিসেবে নয়, অন্তরে উপলব্ধির বিষয় হিসেবেও দেখা হয়। সুফিরা মনে করেন, আল্লাহর একত্ব শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক উপলব্ধি নয়, বরং এক ধরনের আত্মিক অভিজ্ঞতা, যা সাধনার মাধ্যমে অনুভব করা যায়। সুফিদের কাছে তাওহীদ মানে আল্লাহ ব্যতীত আর কিছুই নেই—’লা মাওজুদা ইল্লাল্লাহ’। তারা এই দর্শনকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেন যেখানে সৃষ্টিজগতের সব কিছু আল্লাহর অস্তিত্বে বিলীন। পারস্যের সুফি দার্শনিক মনসুর হাল্লাজের ‘আনাল হক’ (আমি সত্য) তত্ত্বটি তার এক বিখ্যাত প্রকাশ। সুফিবাদের তাওহীদ চর্চা সাধারণত ধ্যান, জিকির, কাওয়ালি বা আধ্যাত্মিক সংগীত এবং মুর্শিদ বা পীরের নির্দেশনার মাধ্যমে পরিপূর্ণতা লাভ করে। ইতিহাসে দেখা যায়, এই ধারা দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় সুফিদের এসেছে ১১শ থেকে ১৩শ শতাব্দীর মধ্যে। সুফিরা সাধারণত সরল জীবনযাপন করতেন এবং ধর্মের বাইরের জাতপাত, বর্ণ, ভাষা সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের কল্যাণে ব্রতী ছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার সুফি সাধকদের মধ্যে হযরত খাজা মূইনুদ্দিন চিশতী, হযরত খাজা মুহাম্মদ নিজামুদ্দিন আউলিয়া, হযরত খানজাহান আলী, হযরত শাহ জালাল প্রমুখ সুফি সাধকদের নাম উল্লেখযোগ্য। এই সুফি সাধকদের প্রচার কেবল ধর্মীয় নির্দেশনায় সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তারা স্থানীয় জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি ও দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ধর্মীয় মূল্যবোধকে যুক্ত করে ইসলামকে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন। এই চর্চার ফলে তাওহীদের ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে সহজভাবে প্রবেশ করে; যার প্রমাণ আমরা কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘তৌহিদেরই মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম’ থেকে শুরু করে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম পুরুষদের মধ্যে জনপ্রিয় নাম হিসেবে দেখতে পাই। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় তাওহীদ হৃদয় বা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সেসবের কয়েকটি উদাহরণ।
তবে শব্দ যেমন সময় ও প্রেক্ষিতের পরিবর্তনে বদলে গিয়ে ভিন্ন কোনো অর্থ তৈরি করে থাকে অনেক সময়, তেমনটাই ঘটেছে এই তৌহিদী জনতার ক্ষেত্রে। এই তৌহিদী জনতারা কোনো একটি নির্দিষ্ট দল বা সংগঠনের সদস্য নয় বরং এটি একটি ব্যানার যার আশ্রয়ে সাধারণত কিছু জনগণ, যারা ইসলামের ভিত্তিতে কোনো একটি বিষয়ে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন।
গবেষকদের মতে, ‘তৌহিদী জনতা’ একটি স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মীয় আবেগ  বা প্রতিক্রিয়ার প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে কোনো নির্দিষ্ট নেতৃত্ব না থাকলেও কিছু ধর্মীয় বক্তা বা স্থানীয় নেতৃত্ব এদের প্রভাবিত করে থাকেন।
এই ব্যানারে কখনো দেখা গেছে বইমেলায় ‘অবমাননাকর’ বইয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, কখনো দেখা গেছে সংবাদপত্রের প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে সমাবেশ, এমনকি নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তাকারীকে রক্ষার ক্ষেত্রেও ঢাল হিসেবে দেখা গেছে এই ব্যানার। আবার কখনো কারো বিরুদ্ধে ‘ইসলাম অবমাননার’ অভিযোগ তুলে জনতার চাপ সৃষ্টি করতে দেখা গেছে। ‘তৌহিদী জনতা’ পরিচয়ে বিভিন্ন মাজারে হামলা ও সুফিবাদবিরোধী বক্তব্যও এর আওতায় পড়েছে বলে গণমাধ্যমে এসেছে। যদিও এসব ঘটনার মূল প্রেক্ষাপটে থাকে ধর্মীয় অনুভূতি ও নৈতিক শুদ্ধতা রক্ষার উদ্বেগ, তবে এর সামাজিক প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিফলন জটিল ও বহুমাত্রিক।
আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের স্কুল অব সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্লোবাল স্টাডিজের শিক্ষক সাঈদ ইফতেখার আহমেদের মতে, ‘তাওহীদ’ যেখানে ইসলামের একটি গভীর আধ্যাত্মিক ও নৈতিক ধারণা, সেখানে এর রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রয়োগ অনেক সময় মূল দর্শন থেকে বিচ্যুত হতে পারে।
বাংলাদেশের মতো ধর্মপ্রাণ সমাজে ধর্মীয় পরিচিতি অনেক সময় এক ধরনের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে ‘তৌহিদী জনতা’ নামটি একটি বৃহত্তর ধর্মীয় অনুভূতির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, তার ব্যবহার ও প্রতিফলন ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন মাত্রা গ্রহণ করতে পারে। এখানে দ্বিমুখী ধারা কাজ করে, একদিকে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের ন্যায়বোধ, অপরদিকে ধর্মীয় আবেগকে রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার। এই ব্যবহারের ফলে অনেক ধর্মীয় শব্দের অর্থ বা ব্যাখ্যা নানাভাবে পাল্টে যেতে পারে।
ইসলামে বান্দার অধিকার, বা ‘হাক্কুল ইবাদ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাস। এটি মানুষের প্রতি আল্লাহর নির্দেশনা, যা মানবাধিকার, মানবিক মর্যাদা এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতির প্রতি গুরুত্ব দেয়। তাওহীদের গুরুত্ব তাই এখানেই যে তা শুধু আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি মানুষের পরস্পরের প্রতি নৈতিক দায়িত্ব জাগিয়ে তোলে। এখানে, হাক্কুল ইবাদ সম্পর্কে চিন্তা করার সময়, বিশেষ করে তৌহিদী জনতা নামক ধর্মীয় গোষ্ঠীটির অবস্থান এবং তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতিফলন আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরে। ধর্মীয় অনুভূতিকে উসকে দেয়, কখনো কখনো এই গোষ্ঠী ‘অবমাননার’ বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই আধ্যাত্মিক আন্দোলন বা প্রতিবাদ কি সবসময়েই মানবাধিকার ও সহানুভূতির পক্ষে যাচ্ছে, নাকি তা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠী বা মতাদর্শের প্রতি আক্রমণ বা বৈষম্যের পথে পরিচালিত করছে?
এই প্রশ্নে গবেষকেরা মনে করেন, বাংলাদেশের তৌহিদী জনতারা তাওহীদ ও হাক্কুল ইবাদের প্রয়োগের ক্ষেত্রে মানুষের প্রতি বৈষম্য না রেখে বরং মানবিক মর্যাদা, ন্যায় এবং সহনশীলতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এই কথাটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, তৌহিদী জনতার বর্তমান কর্মকাণ্ড যদি এই বিশাল দর্শনের সঠিক প্রয়োগে পরিণত হয়, তবে তারা শুধু নিজেদের ধর্মীয় অনুভূতি রক্ষা করবে না, বরং সামাজিক শান্তি ও মানবিক মর্যাদার প্রতিষ্ঠাও নিশ্চিত করবে। তার জন্য প্রয়োজন সহনশীলতা, আত্মজিজ্ঞাসা, এবং পরস্পরকে বোঝার চেষ্টা করা।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment