×

আইয়ুব বাচ্চুর ব্যান্ডের নাম ‘এলআরবি’ হয়েছিল কনসার্ট–আয়োজকদের ভুলে, জানেন কি?

প্রয়াত রকস্টার আইয়ুব বাচ্চুর ‘এলআরবি’ ব্যান্ডের জন্ম ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে। একটা ব্যান্ডের নাম বদলে যাওয়ার পেছনে এমন নাটকীয়তা খুব একটা দেখা যায় না। আর এর কেন্দ্রে যদি থাকেন আইয়ুব বাচ্চুর মতো তারকা, তাহলে গল্পটা হয়ে ওঠে ইতিহাসের অংশ। এলআরবির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জনপ্রিয় এই ব্যন্ডের অজানা কাহিনি জানাচ্ছেন গৌতম কে শুভ

৩৪ বছর আগের কথা। ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল। ঢাকার একটি বিদেশি দূতাবাসের ক্লাবে আলো-আঁধারিতে সাজানো মঞ্চ। নতুন একটি ব্যান্ড প্রথমবারের মতো তাদের উপস্থিতি জানান দিতে যাচ্ছে। ব্যান্ডটি ছিল আইয়ুব বাচ্চুর নিজের গড়া, যার নাম তিনি রেখেছিলেন ‘ইয়োলো রিভার ব্যান্ড’। সংক্ষেপে—YRB। সেই ব্যান্ডে তখন বেইজে স্বপন, ড্রামসে জয়, আর কিবোর্ডে ছিলেন এস আই টুটুল। একদল তরুণ, একরাশ স্বপ্ন, আর নতুন কিছু বলার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে তাঁরা ওঠেন সেই মঞ্চে। কিন্তু যখন তাঁরা মঞ্চে উঠলেন, ব্যানারের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তাঁদের ব্যন্ডের অন্য নাম—‘লিটল রিভার ব্যান্ড’ (LRB)।
ব্যান্ডের সদস্যরা সবাই–ই অবাক! নিজেদের দলের নামই বদলে গেছে! আয়োজকদেরকে এই ভুল নিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর এসেছিল, নামটা আমাদের কাছে বেশি ভালো লেগেছে। তাই প্রচারের সময় এ নামই ব্যবহার করেছি।
ভাবা যায়? এমনটাও হয়!

এভাবেই ‘এলআরবি’ নামের জন্ম, হঠাৎ করে এবং অনিচ্ছাকৃত এক ভুল থেকে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ভুলই হয়ে গেল পরিচয়। হয়ে উঠল ইতিহাস।

এখন অনেকেই ভাবছেন, ‘এলআরবি’র পূর্ণরূপ তো ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’ ছিল না! সবখানে দেখেছি এলআরবি মানে ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’। ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’ কেন বলছি তাহলে!
এখানেও আছে নাটকীয়তা!

গিটার-ধ্যানী আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: সংগৃহীত

আরও যত নাটকীয়তা
যতদূর জানা যায়, ১৯৯৮ সালে ব্যান্ডের যুক্তরাষ্ট্রে কনসার্ট ট্যুরের জন্য ভিসার কাগজপত্র প্রস্তুত করার সময়কালে ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’ থেকে নামটি পাল্টে হয় ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’।
কারণ?

‘লিটল রিভার ব্যান্ড’ নামে অস্ট্রেলিয়ায় আগে থেকেই একটি ব্যান্ড ছিল। ১৯৭৫ সালে তৈরি হওয়া ব্যান্ডটি ততদিনে ১১টি অ্যালবাম প্রকাশও করেছে। হয়তো তখনকার দিনে ইন্টারনেট, ইউটিউবে গান শোনার সুযোগ না থাকায় অস্ট্রেলিয়ার এই ব্যান্ডের খবর তাঁরা আগে পাননি। কিংবা নাম জেনে থাকলেও তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন দেশ আলাদা, ভৌগোলিক দুরত্ব অনেক। তাই হয়তো অসুবিধা হবে না। এখানেও ব্যান্ড লিডার হিসেবে আইয়ুব বাচ্চুর দূরদর্শীতার পরিচয় পাওয়া যায়।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে পা রাখার স্বপ্ন আইয়ুব বাচ্চুর ছিল অনেক আগে থেকেই। সেক্ষেত্রে আলাদা নাম জরুরি, একই নামে ব্যান্ড থাকলে তো হবে না। সব মিলিয়ে তাই ব্যান্ডের নাম বদলানোর এই সিদ্ধান্ত।

সেই থেকেই ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’ হয়ে যায় ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’। একটা অক্ষর বদলেও যেন পরিচয়ের চিহ্ন মুছে না যায় কখনো। তাই রেখে দেওয়া হয় সেই তিনটি অক্ষর—L, R, B (এল, আর, বি)।

এলআরবি’র প্রথম অ্যালবাম। প্রথম লাইনআপে এই ছিলেন এই চারজন। ছবি: সংগৃহীত

রবিন থেকে আইয়ুব বাচ্চু
এলআরবির নাম বিভ্রাট নিয়ে যত কথাই বলি না কেন, তার চেয়েও বিস্ময়কর গল্প হলো একজন রবিন থেকে আইয়ুব বাচ্চু হয়ে ওঠার কাহিনি। চট্টগ্রামের পটিয়ায় জন্ম নেওয়া আইয়ুব বাচ্চুর ডাকনাম ছিল রবিন। পুরো নাম মোহাম্মদ আইয়ুব বাচ্চু। ‘এলআরবি’ তৈরির আগেই প্রায় দেড় দশক ধরেই তিনি পেশাদার মিউজিশিয়ান হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ‘রিদম ৭৭’, ‘স্পাইডার’, ‘ফিলিংস’—এসব ব্যান্ডের হয়ে এক দশকের ‘সোলস’পর্ব শেষ করার পরেই ব্যান্ড লিডার-ফ্রন্টম্যান হিসেবে নতুন ব্যান্ড ‘এলআরবি’র যাত্রা।

আইয়ুব বাচ্চু যখন ‘সোলস’ ছাড়লেন, তখন অনেকে অবাক হয়েছিলেন। ‘সোলস’ সে সময় বেশ জনপ্রিয়। মেলোডিনির্ভর গানের জন্য পরিচিত তারা। কিন্তু বাচ্চু ভালোবাসতেন গিটারের ঝংকার, স্টেজে বাজানো সেই উচ্চস্বরে গর্জন করা রক সাউন্ড। তাঁর ‘সোলস’ থেকে বের হয়ে আসাও অনেকটা এজন্যই। যেন গিটার শোনাতে হবে বলেই তাঁর গান গাওয়া। তাই ‘সোলস’ থেকে ‘এলআরবি’র দিকে যাত্রা মূলত এবির (আইয়ুব বাচ্চুকে সংক্ষেপে ‘এবি’ নামে ডাকা হয়) মেলোডি থেকে রকের দিকে যাত্রা।
এরপরের ইতিহাস সবার জানা। ‘এলআরবি’ শুধু ব্যান্ড নয়, হয়ে উঠল এক রক আন্দোলন।

‘এলআরবি’র প্রথম লাইনআপ, এঁদের হাতেই তৈরি হয়েছিল ব্যান্ডটি (বামে)। আইয়ুব বাচ্চুর একক অ্যালবাম ‘ময়না’র কাভার (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

‘সোলস’–এ থাকার সময়ই বের হয় আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম একক অ্যালবাম বের হয় ‘মোহা. আইয়ুব বাচ্চু’ নামে। এটা অবশ্য সে সময়ে আলোড়ন তুলতে পারেনি। কিন্তু পরের অ্যালবাম ‘ময়না’ (১৯৮৮) প্রকাশের পর তাঁর গান মানুষ শুনতে শুরু করে। ঠিক ওই সময়ই প্রথম সেলফ টাইটেলড অ্যালবামটি ‘রক্ত গোলাপ’ নামে আবারও প্রকাশিত হয়। এরপর শ্রোতারা টের পান, তিনি শুধু গিটার বাজান না, গাইতেও জানেন। হয়তো এই দুই অ্যালবামের গানগুলো শ্রোতারা ভালোভাবে গ্রহণ করার ফলেই আইয়ুব বাচ্চু গায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশের সাহস পেয়েছিলেন, নিজের ব্যান্ড নিয়ে।

‘এলআরবি’ স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে নতুন কিছু গড়ার নাম, একটা নিয়ম ভাঙার স্পর্ধা, একটা গল্প। ‘চলো বদলে যাই’ থেকে ‘রূপালী গিটার’, ‘শেষ চিঠি’ থেকে ‘ফেরারী মন’— প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেভাবে গানগুলোকে ভালোবাসছে, তাতে প্রমাণিত হয়, আইয়ুব বাচ্চুর গান কখনো পুরোনো হয় না।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment