×

হুমায়ূন আহমেদের রাজনৈতিক চোখ

হাসান জামিল

অনেকের অভিমত, নন্দিত লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের লেখা ও দেখার মধ্যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সেভাবে হাজির নয়। কথাটি কতটা সত্য? চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ২০০৩ সালে মুক্তি পাওয়া তাঁর ‘চন্দ্রকথা চলচ্চিত্রের আলোকে এ নির্মাতার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সুলকসন্ধান 

বাংলাদেশের শিল্পচর্চায় হুমায়ূন আহমেদ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, মৃত্যুর এত বছর পরেও তাঁর জনপ্রিয়তা ঈর্ষা করার মতোই। এটাকে অনেকেঅপরাধ’ হিসেবে দেখেন, অনেকে আবার একে নিজেরব্যবসা’য় কাজে লাগিয়েছেন। তাই উন্নাসিক ব্রাহ্মণ ব্যবসায়ীকে ধর্তব্য সীমার বাইরে রাখাই মঙ্গল। হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয়তার চরম মাত্রা স্পর্শ করার সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক রয়েছে। তাঁর টিভি নাটকগুলো অভাবনীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করে, তাঁকে পরিচিতি এনে দেয়, তাঁর বইয়ের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তোলে। সেই সুবাদে এই লেখকের আর্থিক উন্নতিও ঘটে অভাবনীয়। এই উন্নতির ফলে তাঁর ভেতর ঘুমিয়ে থাকা চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্তাটি সামনে আসে। তিনি সেই সময় তার বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি লয় করে নেমে যান সিনেমা তৈরিতে। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সিনেমা বানানো একটিঘটনায়পরিণত হয়।

হুমায়ূনের প্রথম সিনেমাআগুনের পরশমণি’, একটি দুঃসাহসিক কাজ বলতে হবে। দুঃসাহসিক এই জন্য যে তিনি সেই সময় সিনেমা বানানোর জন্য গল্পের বিষয় হিসেবে বেছে নেন মুক্তিযুদ্ধ, যে সময়টায় সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। শুধু তা নয়, তিনি সরকারি অনুদানে সিনেমাটি নির্মাণ করেন। সম্ভবত প্রথমবারের মতো বাংলা সিনেমায় ফাইটিং দৃশ্য ধারণের জন্য সহায়তা নেন সেনাবাহিনীর! এসব বিস্ময়ের জন্ম দেয়, আবার দেয়ও না। বিস্ময়ের জন্ম দেয় কারণ, এটা আর কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না, আবার বিস্ময়ের জন্ম দেয় না, কারণ এটাই হুমায়ূন আহমেদ।

হুমায়ূন আহমেদের চরিত্ররা আমাদের চারপাশের মানুষ। তার চরিত্ররা কম অভিনয়প্রবণ, উচ্চকণ্ঠ নয়। স্বাভাবিক চলাফেরা। তার সিনেমার চরিত্ররা ওই চারিত্র্যটি বেশ ধারণ করে। ভারিক্কী কম, সহজ, কমিউনিকেটিভ, ইঙ্গিতের বেড়াজালে আবদ্ধ নয়, মন্তাজের ভারে ন্যুব্জ নয়। অনেকটা রবিঠাকুরের সহজ কথা কইতে আমায় কহযে উল্টাপাঠ। তিনি যেন সব কথা সহজেই বলে দিচ্ছেন। হ্যাঁ, তার চরিত্ররা প্রগলভ, অনেক কথা বলে। কথায় কথায় তিনি গল্প বলেন। ভিজ্যুয়াল গল্প। গল্প বলার যে কৌশলটি তিনি নিজের লেখালেখিতে রপ্ত করেছেন, তা-ই যেন তিনি সিনেমা মাধ্যমে বলে যান।  হুমায়ূন কত বড় চলচ্চিত্র নির্মাতা, সেটা ভিন্ন আলোচনা হতে পারে; কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্রে তাঁর অবদান হলো ভিজ্যুয়াল গল্প বলার একটি নতুন মাত্রা যোগ করা। এই ক্ষেত্রেটি তাঁকে আবশ্যক পাঠের আওতায় নিয়ে এসেছে।

হুমায়ূনের লেখালেখি, নাটকসিনেমার বিরুদ্ধে সবচে বেশি যে অভিযোগটি করা হয়ে থাকে, সেটি হচ্ছে, তিনি তাঁর চরিত্রের মধ্যে বিদ্রোহের বীজ দেন না বরং কেড়ে নেন। গরিবশোষিতেরা তাঁর নির্মাণের ভেতর বিদ্রোহী না হয়ে হাস্যকর হয়ে ওঠে। তাঁর প্রতিটি নাটকসিনেমায় কাজের ছেলে ও মেয়ে থাকে এবং তাঁরা তাঁর নির্মাণের ভেতর দিয়ে হাস্যরসাত্মক পরিস্থিতির জন্ম দিয়ে অতঃপর নিজেরাই হয়ে ওঠে হাস্যকর। নানান মজার কীর্তিকলাপ করে বেড়ায় তারা, আড়ালে সাহেববিবি সাজে, আধাখাস্তা দার্শনিকতা আর কিম্ভূত পোশাক তাদের নিতান্ত জোকারে পরিণত করে রাখে এবং এই চরিত্রদের বিকশিত হতে দেওয়া হয় না।  এর পেছনে একটা কারণ হতে পারে এই যে হুমায়ূন তাঁর চরিত্রের ওপর কোনো আলগা ভার আরোপ করতে নারাজ। কিন্তু তাঁর সব ভিডিও-ফিকশনই এই দায় বহন করে, তা কিন্তু নয়। এর একটি অ্যান্টিস্টাডি হতে পারে তার নির্মিত তৃতীয় চলচ্চিত্রচন্দ্রকথা’।

চন্দ্রকথা চলচ্চিত্রটি গ্রামের মেয়ে চন্দ্রের নামে হলেও এতে রয়েছে মূলত চারটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। চন্দ্র (শাওন) ছাড়া অন্য তিনটি চরিত্র হচ্ছে জমিদারিহীন জমিদার সরকার সাহেব (আসাদুজ্জামান নূর), চন্দ্রের খালাতো ভাই জহির (ফেরদৌস), সরকার সাহেবের ভৃত্য আমিন (আহমেদ রুবেল) ছাড়া অন্যান্যের সঙ্গে সরকার সাহেবের পঙ্গুপুত্র আর পুত্রবধূ, চন্দ্রের মা, গ্রাম্য শিক্ষককে দেখা যায়। এই চলচ্চিত্রে হুমায়ূন আহমেদ যে দৃষ্টিভঙ্গিটি নিয়ে হাজির হয়েছেন, তা অবশ্যই ক্ষয়িষ্ণু জমিদারবিরোধী, সামন্তবাদবিরোধী।

সিনেমাটা শুরু হয় জমিদারের জমিদারীর মানসিকতার দেখানোর মধ্য দিয়ে, যা গোটা সিনেমায় এই মেজাজেই অব্যাহত থাকে। সিনেমার শুরুতেই সরকার সাহেবকে আসমানে গুলি করে কাক মারতে দেখা যায়। কিন্তু সেই মৃত কাক নিয়ে আসার সময় সরকার সাহেবের ভৃত্যর কাছে তার জমিদারি মানসিকতাকে ব্যাঙ্গ করে স্কুল মাস্টারকে বলতে শোনা যায়, ‘জমিদারি কোন আমলে চইলা গেছে, এখনো ভাব ধইরা বইসা আছে। ভাব দেখলে মনে হয় উনি দশ আনির জমিদার আর আমরা তার প্রজা।

এমন কি তার কাক মারা গুলি ফুটানোয় বিরক্ত হয়ে তার ছেলে বলে বসে, ‘বিরাট বীর আসছে, কাউয়া মারা বীর।এসবই সরকার সাহেবকে চরম বিরক্ত করে। তবে তিনি নিজের যাপনের বাইরে যান না। নিজের জমিদারি মানসিকতা নিয়ে নিজের মতোই থাকেন। জলতরঙ্গ বাজান, নিজের রাজ্যে রাজা হয়ে বসে থাকেন।

সামাজিক পরিবর্তনের এক বিশেষ মুহূর্তে একজন ক্ষয়িষ্ণু জমিদারের শিল্পবোধ, শিল্পের প্রতি দরদ, নষ্টামি, ক্ষমতা দেখানো, নারীর প্রতি লোলুপতা, নিষ্ঠুরতা, সবই একটা চরিত্রের ভেতর হুমায়ূন পুরে দিয়েছেন। অপর দিকে জমিদার যেমন, তার ছেলে ঠিক এর উল্টা; যে কি না বাবার এসব আচরণ একদম সহ্য করতে পারছে না। আবার সে বিছানাবন্দী বলে কিছু করতেও অক্ষম। ফলে নানা অবদমন তার মধ্যেও রয়েছে। বাবার প্রতি তার তীব্র ঘৃণা লক্ষণীয়। জমিদার সরকার সাহেবের ভৃত্য আমিনও সেই শেষ প্রজন্মের ভৃত্য, যারা প্রভুর জন্য সব করতে প্রস্তুত। সম্ভবত পৃথিবী থেকে এই ভৃত্য শ্রেণীরও বিলোপ হয়েছে, সামন্তবাদের সঙ্গে।

সিনেমাটিতে দেখা যায় চন্দ্র জমিদারবাড়িতে দুধ দিতে যায়, আর সেই দুধ রাখে আমিন। তাদের সামান্য বাক্যালাপ হয়। আমিন তার প্রেমে পড়ে। জমিদারের অনুমতি সাপেক্ষে বিয়ের দিনও ঠিক হয়। অন্যদিকে চন্দ্র মজে আছে তার হইচই করে বেড়ানো, কাকের মাংস খাওয়া অকর্মণ্য খালাতো ভাই জহিরের প্রেমে। বিয়ের দিন তারা পালিয়ে যায়। এদিকে আমিন আশাহত হয়ে ফিরে আসে। সেই সময়ের গ্রামে যা হওয়ার তাই হয়। সামাজিকভাবে মেয়ের পরিবার, পরিবার বলতে চন্দ্রের মা একা, মুখ দেখানোর মতো অবস্থায় থাকে না। সে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু জহির আর চন্দ্র বাড়ি ফেরে। তাদের একঘরে করার আয়োজন করা হয়। এর মধ্যেই সরকার সাহেব চন্দ্রের গলায় গান শুনে মুগ্ধ হন, দিঘির ঘাটে। চন্দ্রের পরিবারকে বাঁচানোর নাম করে তিনি চন্দ্রকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তার কোথায় কোথায় যাওয়াআসায় নিষেধাজ্ঞা, এমন কি চন্দ্রের সঙ্গহীন মায়ের জমিদার বাড়িতে আসাযাওয়াও নিষিদ্ধ করা হয়। 

অন্যদিকে চন্দ্রের প্রেমিক ফিরে আসে গ্রামে। সে জমিদার বাড়ির আশপাশে হাঁটাহাঁটি করে, বৃষ্টি ভিজে অসুখ বাধায়। আর জমিদারের ভৃত্য বিশ্বস্ততার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করে যায়।  এদিকে চন্দ্রের কাছে যেমন সাড়া আশা করেন, তা না পেয়ে সরকার সাহেব ক্ষিপ্ত হতে থাকেন। পুরোনো প্রেমের প্রতি দায় আর যার সঙ্গে বিয়ে হবার কথা সেই আমিনের প্রতি চন্দ্রের অপরাধবোধ সরকারকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। তিনি শাস্তি দেন। চন্দ্রের আঙুল সুপারি কাটার যন্ত্র দিয়ে কাটার নির্দেশ দেন আমিনকে। আমিন যথারীতি নির্দেশ মান্য করে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে ফুঁসতে থাকে। যা আপাত দৃষ্টিতে বোঝা না গেলেও শেষ পর্যন্ত চরম রূপ নেয়। যার সঙ্গে আমিন এক ইউটোপিয়ান সংসার পেতেছিল, তার ওপর অত্যাচার! এ বাস্তবতায় নিজের ওপর মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া আমিন চরম বিদ্রোহ করে বসে। এক মুহূর্তের সেই বিদ্রোহ। সরকারের বন্দুক দিয়েই সে গুলি করে সরকার সাহেবকে। মোটা দাগে গল্পটি এই রকম।

এই গল্পের অপরাপর উপগল্পের থেকে আমিন চরিত্রের দিকে আলাদা করে ফোকাস করলে আমরা দেখতে পাই সেই প্রচলিত কথাটিই জিতে যাচ্ছে। কথাটি হলো, দেয়ালে পিঠ ঠেকলে মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। এই সিনেমায় আপাত নিন্মবর্গের মানুষের জয় দিয়েই শেষ হয়। নিন্মবর্গের বিদ্রোহের সৌন্দর্য নিয়ে সিনেমাটি শেষ করার মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ অনেক প্রশ্নের জবাব হাজির করেছেন। এই এই সিনেমায় সামন্তীয় মানসিকতার নোংরামি, সামন্তবাদের একধরনের পরাজয়ের চিত্র আঁকা হয়েছে। সিনেমাটি দেখার পর যে কোন সাধারণ দর্শকের সামন্তবাদ জমিদারদের নষ্টামির প্রতি ঘৃণাবোধ জন্ম নেবে। হুমায়ূনের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তোলেন, তাঁদের জন্য সিনেমাটি একটি উদাহরণ হতে পারে। এর বাইরে হুমায়ূনের বানানো সিনেমাগুলোতে তাঁর রাজনৈতিক কমিটমেন্টের কমতি ছিলও বলে যাঁরা বিলাপ করেন, তাঁদের নিশ্চয়ই জানা আছে, তিনি তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রটি ছাড়াওশ্যামল ছায়ানামে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন। তা ছাড়া, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রেও গ্রামীণ ভূস্বামীকে ১৯৭১সালের কৃতকর্মের জন্য মাফ চাওয়াতে দেখা যায়।

হুমায়ূন আহমেদ মূলত স্টোরিটেলার। তিনি টেক্সট আর ভিজ্যুয়ালএই দুই মাধ্যমেই গল্প বলেছেন। তিনি যে কাজটি করেননি সেটা হলো, তার চরিত্রে  আলগা মতাদর্শ আরোপ করা। এটি তাঁর শক্তির জায়গা। আলগা মতাদর্শ যাঁরা চান, তাঁদের জন্য এটা অবশ্যই বেদনার। রাজনৈতিক গল্প নির্বাচনের জন্য, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের বাইরেচন্দ্রকথা’ নিয়ে কথা বলা একটু অসুবিধাজনক। তবু এটা নির্বাচন করা হয়েছে এই জন্য যে যাঁরা স্থূল অর্থে শিল্পে বিপ্লববিদ্রোহ চান, তাঁদের যেন একটু হলেও দৃষ্টি এদিকে ফেরে। আমাদের প্রয়োজনেই এটা করা দরকার। তা ছাড়া ছবিতে জটিল এক সামাজিক স্তরবিন্যাস দেখানো হয়েছে; পূর্বতন বাংলাদেশের সমাজ, গ্রামীণ অর্থনীতি, ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্র, যেখানে বুর্জোয়া বিপ্লব হয়নি, হয়নি ধনতন্ত্রের সুষম সমান্তরাল বিকাশ। পূর্বতন এবং এমন কি এখনো বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাসূত্রে সামাজিক সম্পর্কের বিন্যাস যেখানে জটিল বহুস্তরায়িত, সেখানে হুমায়ূনেরে বর্ণনাভঙ্গী অনেক বেশি সত্যানুগ। হুমায়ূন আহমেদ বিপ্লবী নন, বরং প্রচলিত ব্যবস্থা আরেকটু সাউন্ড হোক, এটাই চাইতেন। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টির ভাষ্যকার। মুক্তিযুদ্ধের চলতি বয়ানে তাঁর আস্থা ছিল। সমাজকে দেখার তাঁর যে চোখ তা গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া চোখ, যদিও সমাজ অনেক বেশি জটিল আর এবড়োখেবড়ো। সেই চোখে যা ধরা পড়েছে, হুমায়ূন তা বলেছেন। এই বাস্তবতায় আমাদের চোখ ফেরানো উচিত। 

 

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment