ওয়ারেন হেস্টিং কেন আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
১৭৮১ সালের ১৭ এপ্রিল ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার আলোকে মুসলমানদের জন্য কলকাতা আলিয়া মাদরাসা স্থাপন করেছিলেন ব্রিটিশ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস। সেই ধারাবাহিকতায় পরে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা আলিয়া মাদরাসা। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মীর হুজাইফা আল মামদূহ
অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে আলিয়া মাদরাসা শিক্ষার শুরু হয়েছিল সেই সময়ের গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংয়ের আগ্রহে। ১৭৮১ সালের আজকের দিনে তিনি ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার আলোকে মুসলমানদের জন্য কলকাতা আলিয়া মাদরাসা স্থাপন করেন। এরপর সারা বাংলায় অসংখ্য মাদরাসা গড়ে ওঠে।
যে কারণে কলকাতায় আলিয়া মাদরাসা
‘ভাগ করো ও শাসন করো’-এই নীতিতে ভারতবর্ষ শাসনের এক পর্যায়ে ব্রিটিশরা দেখল, এই অঞ্চলের মুসলমানরা পুরোপুরি তাদের অনুগত নয়। এই প্রেক্ষিতে তাঁরা ভাবল, তাঁদের দরকার কিছু মুসলমান কেরানি, যাদের বাইরেরটা মুসলমান, কিন্তু ভেতরটা হবে বৃটিশ-অনুগত।
ওদিকে এই অঞ্চলেরই কিছু মুসলমান দেখছিল, এই অঞ্চলের হিন্দু শ্রেণি বৃটিশ শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশোনা করে তাদেরই আজ্ঞাবহ হয়ে উঠছে। কিন্তু মুসলমানরা হিন্দুদের এই উত্থান মেনে নিতে পারছিল না। ফলে তারা মুসলমানদের জন্য বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরির আরজি জানাল ব্রিটিশরাজের কাছে। আর ব্রিটিশদেরও যেহেতু অনুগত শ্রেণি লাগবে, তাই ১৭৮১ সালের দিকে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস তৈরি করলেন এক নতুন শিক্ষাব্যবস্থা। সেই শিক্ষাব্যবস্থা ওই সময়ের প্রচলিত ইসলাম শিক্ষাব্যবস্থার চেয়ে আলাদা। সেখানে ইসলামের জরুরি শিক্ষাগুলো তো ছিলই, সঙ্গে ছিল সেই সময়ের ‘ব্রিটিশ অফিসার’ হয়ে ওঠার জন্য জরুরি কিছু পড়াশোনা।
প্রচলিত এই গল্পটি মূলত তাঁরা করেন, যাঁরা আলিয়া মাদ্রাসাকে ঠিক ইতিবাচকভাবে দেখেন না। অনেক ধর্মীয় চিন্তাবিদ মনে করেন, আলিয়া মাদরাসার পেছনে ছিল ইসলামি শিক্ষার আড়ালে ব্রিটিশ শাসকের প্রভাব বিস্তারের পরিকল্পনা। তবে এই মতের সঙ্গে সবাই একমত নন।
কোনো কোনো শিক্ষাবিদ মনে করেন, ইসলামকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য এই অঞ্চলের মাওলানারা নতুন শিক্ষা পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন, যার নাম ’দারসে নেজামি বা দেওবন্দি শিক্ষা’।
বাংলাদেশের ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার একটা বড় কারণ এই মতামতগত ভিন্নতা। তবে ব্রিটিশদের আদলে আলিয়া শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল, মোটা দাগে মুসলমানদের সঙ্গে ব্রিটিশদের দূরত্ব কমিয়ে আনা।
তবে এই লেখায় কওমি মাদরাসা আলোচ্য নয়। সেই সময়ের আলিয়া মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাই মূখ্য বিষয়।
গবেষকেরা বলছেন, সেই সময়ে আলিয়া মাদরাসার জন্য বরাদ্দ ছিল অপ্রতুল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে আলিয়া মাদরাসার জন্য বরাদ্দ চেয়েও পাননি হেস্টিং। তাই নিজের তহবিল থেকেই তিনি শুরু করেন। পরে কোম্পানি বেশ কয়েকটি জায়গায় মাদরাসার ব্যয় নির্বাহের জন্য বরাদ্দ দেয় এবং মাদরাসা পরিচালিতও হয় ব্রিটিশ নির্দেশে।
১৭৯০ সাল পর্যন্ত আলিয়া মাদরাসায় এই অঞ্চলে আগে থেকে থাকা ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা ‘দারসে নেজামি’র পাঠ দেওয়া হতো। ১৭৯১ সালে এর প্রথম সংস্কার হয়। সেখানে ব্রিটিশ নিয়মের আরও কিছু প্রবেশ ঘটে এই শিক্ষাব্যবস্থায়। যেমন ইসলামি ফিক্হের সঙ্গে ব্রিটিশ আইনের পড়াশোনা শুরু হয়। এতে মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন ঘটে। শিক্ষার্থী সংখ্যাও বাড়ে। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মাদ্রাসার দেখাশোনার জন্য বৃটিশ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৮১৯ সালে ক্যাপ্টেন এরোন মাদরাসা সেক্রেটারি নিযুক্ত হন।
১৮২০ সালে নতুন কিছু সংস্কার হয়, তাতে পদ্ধতিগত নানা নতুনত্ব আসে। এতদিন পর্যন্ত মাদরাসার শিক্ষকেরাই শিক্ষার্থীদের উত্তীর্ণ হওয়ার সার্টিফিকেট দিতে পারতেন, এই সময়ে এসে সেই ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে চলে যেতে শুরু করে।
যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো ঢাকা আলিয়া মাদরাসা
নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অবশেষে ১৯৪৭ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার আরবি বিভাগ ঢাকাতে নিয়ে আসা হয়, যা ‘ঢাকা আলিয়া’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড গঠিত হয়। এখন বাংলাদেশে প্রায় ১০ হাজার ৪৫০টি আলিয়া মাদরাসা রয়েছে। এসব মাদরাসায় ৪০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) থেকে কামিল (স্নাতকোত্তর) শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করছেন। আলিয়া মাদরাসার পাঠ্যক্রমে কুরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি সাহিত্যসহ বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
আলিয়া মাদরাসার বর্তমান পাঠ্যক্রম:
ইবতেদায়ি (প্রাথমিক স্তর)
দাখিল (এসএসসি সমমান)
আলিম (এইচএসসি সমমান)
ফাজিল (স্নাতক সমমান)
কামিল (স্নাতকোত্তর সমমান)
যদিও আলিয়া মাদরাসা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমান সমাজের শিক্ষা ও পরিচয় গঠনে এর ঐতিহাসিক অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment