যেখানে নীড় বেঁধেছিল ঢাকার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা
ঢাকা শহরে একসময় ছিলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মানুষেরা। আজ ইস্টার সানডে উপলক্ষ্যে জানা যাক ঢাকার সেই সব অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের গল্প। লিখেছেন রাতুল আল আহমেদ
অঞ্জন দত্তের সেই পরিচিত সুর, ‘মেরি অ্যান’ গুনগুন করতে করতে হঠাৎ মনে হলো, কলকাতার মতো ঢাকাতেও নিশ্চয়ই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের একটা পরিচিতি ছিল। কিন্তু আজকের ঢাকা শহরে তাদের কোনো চিহ্নই যেন আর নেই। তাঁরা কোথায় গেল? কী হলো তাঁদের?
বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাসে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের উপস্থিতির উল্লেখ খুব একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু লেখক শাহাদুজ্জামান এক নিবন্ধে জানাচ্ছেন, একসময় ঢাকায় এবং চট্টগ্রামে বেশ কিছু অ্যাংলো পরিবার বসবাস করত। ঢাকার দিলু রোড ছিল তাদের অন্যতম বাসস্থান—একটি জীবন্ত, জমজমাট অ্যাংলো পাড়া। ঐতিহাসিক আফসান চৌধুরীর স্মৃতিতে এখনো জীবিত সেসব মানুষ, যারা পশ্চিমি পোশাক ও ভিন্ন খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে বাঙালি খ্রিস্টানদের থেকেও নিজেদের আলাদা করে রাখতেন।
অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের উৎপত্তির পেছনে রয়েছে একটি ঔপনিবেশিক ইতিহাস। ফাদার মাইকেল দ্য রোসারিও তাঁর ‘বাংলাদেশে খ্রিস্টমণ্ডলীর ইতিহাস’ বইটিতে লিখছেন, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসার আগেই প্রায় ১৫৩৭ সাল নাগাদ চট্টগ্রামে উপনিবেশ তৈরি করেছিল পর্তুগিজরা। পরে দিনেমার, ওলন্দাজ এবং ব্রিটিশ বণিকরা বাংলায় পসার জমাতে শুরু করে। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তো বাংলার শাসনকর্তা বনে যায়। তখনকার ইউরোপীয় বণিক ও সামরিক কর্মকর্তারা পরিবারসহ আসতেন না। ফলে স্থানীয় নারীদের সঙ্গে বিবাহ বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের মাধ্যমে জন্ম নেয় এক নতুন প্রজন্ম, যাদের আমরা চিনি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নামে। ইউরোপীয় পিতা ও নেটিভ মায়ের এই সন্তানরা গড়ন, ভাষা, বিশ্বাস এবং সংস্কৃতিতে ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র।
আত্মপরিচয়ের সংকটে থাকা এই মানুষদের জন্য ইংরেজি ভাষা এবং খ্রিস্টধর্ম ছিল আত্মপ্রকাশের একটি অবলম্বন। ঢাকার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা উপাসনা করতেন সেইন্ট থমাস চার্চে, যা বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্কের উত্তরে অবস্থিত। চার্চটি ছিল তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।
অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের খাদ্যাভাস ছিল আলাদা। তাঁরা নির্ভর করত বেকারিজাত পণ্যের উপর। ভারী প্রাতঃরাশ, হালকা দুপুর এবং আবারো ভারী রাতের খাবার ছিল তাঁদের নিয়মিত খাদ্যতালিকা। ইউরোপীয় মূল ভূখণ্ডের রান্না প্রণালি, বা কনটিনেন্টাল রেসিপিতে ভারতীয় মশলার মিশ্রণ ঘটিয়ে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন এক নিজস্ব রান্নার ধারা। ঢাকায় কেক কাটার যে সংস্কৃতি—জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকীতে, তার শুরুটাও তাঁদের হাত ধরেই।
সংগীতচর্চায়ও ঢাকার সাংস্কৃতিক জগতে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ছিল বিশাল প্রভাব। ঢাকার প্রথম পশ্চিমি যন্ত্রসংগীতের দোকান ‘মিউজিকাল মার্ট’ এবং প্রথম ব্যান্ডদলটির পেছনে ছিল একজন অ্যাংলো— টেলবার্ট জনসনের হাত। ঢাকাই চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়িকা অলিভিয়া গোমেজও ছিলেন একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, যিনি বেড়ে উঠেছিলেন বঙ্গবাজার এলাকার রেলওয়ে কোয়ার্টারে।
তবুও এত প্রভাব ফেলে যাওয়া এই জনগোষ্ঠী হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে গেল। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকেই তাঁরা একে একে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ায় অনেকেই পাড়ি জমান ভারতে, কেউ কেউ চলে যান ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রে। ফলে ধীরে ধীরে ঢাকা থেকে হারিয়ে যায় ইংরেজি-বাংলা-উর্দুর সেই মিশ্র সাংস্কৃতিক ছায়া।
আজ আর বাহাদুর শাহ পার্কের পাশের চার্চ থেকে ভেসে আসে না গানের সুর, হোটেলের কোনে পিয়ানো বা বেহালা বাজায় না অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কোনো শিল্পী। দিলু রোডের বিকেলে দেখা যায় না ফ্রক পরা, বাজারের ব্যাগ হাতে ফেরা সেই আধা-ফিরিঙ্গি মহিলাদের। তবু, ঢাকার আকাশে কোথাও হয়তো আজও রয়ে গেছে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সেই হারিয়ে যাওয়া গানের মৃদু প্রতিধ্বনি।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment