টিজিং থেকে ইভটিজিং, কেন এতটা ভয়ংকর
টিজিং আমাদের সমাজের এক চেনা ঘটনা। কেন টিজিং করে মানুষ? ইভটিজিং–ই বা কী? কেন টিজিং এতটা ভয়ংকর? লিখেছেন শতাব্দীকা ঊর্মি
১৯ এপ্রিল ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্সের দুই ছাত্রীকে ‘উত্যক্ত’ করার অভিযোগে জাহিদুল ইসলাম পারভেজের সঙ্গে তর্কাতর্কি হয় তাঁরই বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীর। ঘটনার একপর্যায়ে দুই পক্ষকে নিয়ে মীমাংসার পর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জাহিদুলকে একদল যুবক ছুরিকাঘাত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় জাহিদুলকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, পারভেজ ওই দুই মেয়েকে দেখে হেসেছিলেন। তবে কাউকে দেখে হাসাও কি টিজিং বা উত্যক্তকরণ? উত্যক্ত হওয়ার প্রতিক্রিয়াই বা কেমন হতে পারে?
টিজিং কারও কাছে শুধুই ঠাট্টার কৌশল, কারও কাছে ক্ষমতা–প্রদর্শন। টিজিংয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকারও তো হতে হলো পারভেজকে। আপাত বিষয়টি আচরণগত মনে হলেও এর শিকড় গাঁথা আছে মানুষের মনস্তত্ত্বে। মূলত এ কারণেই তৈরি হয় লিঙ্গগত নিপীড়ন আর সামাজিক বৈষম্য।
শ্যামবর্ণের কোনো বন্ধুর নামের আগে ‘কালা’ অথবা মোটা বন্ধুর নামের আগে ‘মোটু’ বা ‘মোটকা’ জুড়ে দেওয়া—কারও গায়ের রং বা স্বাস্থ্যের ধরন নিয়ে টিজ বা উত্যক্ত করা আমাদের সমাজের পরিচিত দৃশ্য। সচরাচর ঘটনা। তবে টিজিংয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হিসেবে দেখা হয় ইভটিজিংকে।
ইভটিজিং কী
‘ইভটিজিং’ বলতে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানিমূলক আচরণ বোঝানো হয়। বাইবেলে ‘ইভ’ হলেন সৃষ্টিজগতের আদি নারী। টিজিং শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘জ্বালাতন’। অক্সফোর্ড অভিধানমতে, ‘ইভটিজিং’ হলো ভারতীয়দের তৈরি করা একটি ইংরেজি শব্দ। শব্দটি পৌরাণিক চরিত্র ইভ ও অ্যাডামের দাম্পত্যের খুনসুটি ধারণা থেকে এসেছে। ১৯৬০ সাল থেকে এটি নারী নিগ্রহের ভাষা হিসেবে এই উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠা পায়। তবে হয়রানির মাত্রাভেদে কখনো কখনো ভাষাটি লিঙ্গবাদী হয়ে ওঠে। লৈঙ্গিক কারণে শারিরীক ও মানসিক হয়রানিকে ‘টিজিং’ শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা হলে শব্দের ভেতরেই হয়রানির মাত্রা ম্লান হয়ে যায়।
যদিও দেশের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’-এ নারীর প্রতি শ্লীলতাহানি, যৌন পীড়নের দণ্ড হিসেবে যেমন সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড রয়েছে, তেমনি দণ্ডবিধি বা পেনাল কোডসহ অন্যান্য বিভিন্ন আইনে বিভিন্ন মেয়াদি দণ্ডের পাশাপাশি অর্থদণ্ডের শাস্তিও রয়েছে।
ইভটিজিং কেন করে মানুষ?
প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর বিখ্যাত ‘স্বপ্ন; মনঃসমীক্ষণের ভূমিকা’ বইয়ে মনোজগতের এক রহস্যের দরজা উন্মোচন করেন। তিনি দেখান, মানুষের প্রতিটি আচরণ, উচ্চারণই একেকটি মনোজাগতিক সংকেত। ফ্রয়েড মানুষের মনোজগতকে যে তিনটি স্তরের কথা বলেছেন তার প্রথমটি হলো ‘ইড’, যার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হয় মনের গোপন আবেগ ও প্রবৃত্তি। টিজিংয়ের বাহ্যিক প্রকাশ।
অনেক সময় মানুষ ভেতরের অবদমন ও হীনমন্যতাকে টিজিংয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করে। টিজিংয়ের মধ্যে যুক্ত হয় নানা আচরণ, যার ভেতরে আবার থাকে ভেতরের সংঘাতের বহিঃপ্রকাশ। মনোবিজ্ঞানী আলফ্রেড অ্যাডলার ১৯২৭ সালে লেখা ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং হিউম্যান নেচার’ বইয়ে এ বিষয়ে বিশদ ব্যখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, হীনমন্যতার অনুভূতি মানুষের মানসিক জীবনকে শাসন করে। অনেক সময় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। জন্মগত নানা দুর্বলতা থেকে মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হওয়ার প্রবল তাগিদ জন্মায়। কেউ কেউ সেই তাগিদ পূরণ করতে গঠনমূলক কাজ করে, কেউবা করে টিজিংয়ের মতো নেতিবাচক কাজ।
কোন কোন আচরণকে টিজিং বলা যাবে?
গায়ের রং, স্বাস্থ্যের ধরন ও শারিরীক ত্রুটি নিয়ে ঠাট্টাও টিজিংয়ের মধ্যে পড়বে। যেকোনো অবস্থান থেকে রসিকতার মধ্য দিয়ে দুর্বলকে অবনত করতে চাওয়াই টিজিংয়ের সাধারণ উদ্দ্যেশ্য।
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের দেশে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ক্ষমতাকাঠামোর ভেতরে নারীকে দেখা হয় ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে। যেখানে তাঁর অস্তিত্ব ও মর্যাদা বেশির ভাগ সময় পুরুষের ভাবনার আলোকে নির্ধারিত হয়। এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জানান, ইভটিজিং মূলত বায়োলজিক্যাল ভাবনা থেকেই করা হয়। এর সঙ্গে যৌনতার সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। এমনকি আমাদের দেশের অনেক জনপ্রিয় গানের মধ্যেও ইভটিজিংকে বৈধতা দেওয়া নজির আছে। কারণ নারীরকে উত্যক্ত করা যে একটা অপরাধ, তা নিয়ে অতিসম্প্রতি হয়তো আমরা কিছুটা সচেতন হতে শুরু করেছি।’
এ প্রসঙ্গে শিল্পী মাকসুদুল হকের বিখ্যাত গান ‘মেলায় যাই রে’–এর কথা বলা যায়। এ গানের একটি শব্দ নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে শিল্পীকে। ‘বখাটে ছেলের ভিড়ে ললনাদের রেহাই নাই’—এ বাক্যের ‘বখাটে’ শব্দটি পরিবর্তনের দাবিও উঠেছে বেশ কয়েকবার।
মেলায় বা ভীড়ে নারীর হয়রানি একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হলেও তা চিহ্নিত করার বাস্তবতা এখনো আমাদের এখানে সুলভ নয়।
নারীও কি পুরুষকে টিজ করে?
রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা বলেন, ‘সামাজিক ক্ষমতা কাঠামোয় মেয়েরা নিচের দিকে। হাস্যরস বা ঠাট্টা করে মন্তব্য করা ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। লৈঙ্গিক ও শ্রেণিগতভাবে নারীরা যেহেতু ক্ষমতায়িত না বা তাঁদের কর্তাসত্তা নেই, তাই তাঁরা সেই অব্দি যেতে পারেন না। এমনকি স্বাভাবিক অনুভূতি প্রকাশেও নারীর স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। ক্ষমতাচর্চার মূল মাধ্যম হলো ভাষা। তাই যাঁর ক্ষমতা থাকে না, তার এ ধরনের প্রকাশও ঘটে না।’
বেশির ভাগ নারী মূলত মানসিকভাবে পিতৃতান্ত্রিক ভাবধারা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন। যেমন, ভালোবাসার মতো সিদ্ধান্ত নিলেও তা তাঁরা প্রকাশ করতে চায় না, যাতে তাকে কেউ ‘নির্লজ্জ’ না মনে করে। নারীর এরকম নানা মানবীয় অনুভূতিই যেখানে ক্ষমতাকাঠামোর মধ্য দিয়ে বাধা পায়, সেখানে অন্যকে টিজ করার ভাবনা ভাবতেও এদেশের নারীর তৈরি করতে হয় পাহাড়সম সাহস।
তবে কখনো কখনো নারীও টিজ করেন, যা সাধারণত নিজেদের রসিকতার গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকে। ক্ষমতার প্রধান বাহক পুরুষ পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে না। আবার ক্ষমতার চেহারা বুঝতে হলে শুধু ক্ষমতাধারীর কাছেই যাওয়া যেতে পারে কখনো কখনো, লিঙ্গের কাছে নয়। যেমন কোনো যৌনপল্লীতে যদি একজন সুবোধ বালক পা রাখে, তবে তাহলে যৌনকর্মীরা তাকে ঘিরে তামাশা করতে পারেন। এক্ষেত্রে ভূক্তভোগীর লৈঙ্গিক পরিচয় নয় বরং ক্ষমতার অপব্যবহার হয়ে ওঠে মূল বিষয়।
টিজিংকে হালকা চালে নিতে নিতে আমরা ইভটিজিংয়ের মতো বিকারের ধাপে নেমে যাই। ঠাট্টার মতো টিজিং বা জ্বালাতনকে ব্যঙ্গাত্মক হাস্যরসের ঊর্ধ্বে নিয়ে যাই ফ্রয়েড নির্দেশিত মনোবিকার থেকে। ফলে অনেক টিজিং শেষে সহিংসতায় গিয়ে শেষ হয়।
২২ এপ্রিল মঙ্গলবার ‘সমকাল’–এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মাদ্রাসায় যাওয়া-আসার পথে বিভিন্ন সময় মাইমুনা নামে এক নারীকে উত্ত্যক্ত করত একই এলাকার ওমর রাহিম । ঘটনাটি স্থানীয়দের জানালে ওমর রাহিম আরও ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। একপর্যায়ে মাইমুনাকে নিয়ে ওমর এলাকায় বিভিন্ন কুৎসা রটায়। ২৩ অক্টোবর সকালে মেয়েকে বাসায় রেখে তার মা কেনাকাটার জন্য স্থানীয় করইতলা বাজারে যান। এরমধ্যে তিনি ঘরে গলায় ফাঁস নেন।
ইভটিজিং থেকে পরিত্রাণের ব্যাপারে রেজওয়ানা করিমের পরামর্শ হলো, স্নিগ্ধা বলেন , ‘সমাজে সাহসী নারীদের খুব প্রয়োজন। ক্ষমতার বিপরীতে নারীদের সামাজিক বয়ান থাকতে হবে।’
আর টিজিং থেকে কীভাবে দূরে থাকব আমরা?
আমাদের একে অপরের নির্মল বন্ধুত্বও যখন সাবধানতার চাপে নিরস হয়ে ওঠে, প্রেম বা দাম্পত্য সম্পর্কগুলোও মাত্রাজ্ঞানের চাপে যখন থাকে কিছুটা তটস্থ, তখন এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা হয়তো খানিকটা রসিকতা করি একে অপরের সঙ্গে। তবে এসব ক্ষেত্রে খেয়াল রাখা জরুরি যে আমি আমার বন্ধু বা সঙ্গীর সঙ্গে এমন কোনো রসিকতা যেন না করি, যাতে তিনি আপমানিত হয়। তাই এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিদান হলো, পরিমিতিবোধ আর কাণ্ডজ্ঞানই টিজিং থেকে আমাদের দূরে রাখতে পারে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment