×

বুদ্ধের দেহাবশেষের রত্ন উঠলো নিলামে, প্রশ্ন নৈতিকতার

৭ মে বুধবার হংকংয়ের বিখ্যাত নিলাম সংস্থা সোথেবিজে এমন এক রত্নভান্ডার নিলামে তোলা হতে যাচ্ছে যেটি বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত। একে আধুনিক সময়ের সবচেয়ে চমকপ্রদ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

১৮৯৮ সালে ভারতের উত্তরাঞ্চলের একটি পরিত্যক্ত স্তূপ থেকে এই রত্নগুলো আবিষ্কারের পর এক শতকেরও বেশি সময় ধরে এক ব্রিটিশ ব্যক্তিগত সংগ্রাহকের কাছে সংরক্ষিত ছিল।

এখন এগুলো যখন সংগ্রাহকদের হাত থেকে বেরিয়ে আসছে, তখন তা কেবল অন্যান্য সংগ্রাহকদের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলছেই না বরং কিছু অস্বস্তিও জাগাচ্ছে।

এই ভান্ডারে রয়েছে প্রায় ১৮ শ মুক্তা, চুনি, পোখরাজ, নীলাকান্তমণির সঙ্গে নকশাকাটা সোনার পাত। এগুলো বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের এক ইটের কুঠুরির ভেতর থেকে পাওয়া গিয়েছিল, যা কি না বুদ্ধের জন্মস্থানের খুব কাছেই।

এই উৎখননে বুদ্ধের নাম খোদাই করা এক ভষ্মাধারের ভেতর দেহাস্থি খুঁজে পাওয়ার পর তা প্রত্নতাত্ত্বিকদের ভেতর আলোড়ন তোলে। সোবেথিজের এশিয়া শাখার প্রধান ও বৈশ্বিক এশীয় শিল্পের প্রধান নিকোলাস চাউ বিশ্বাস করেন এটি ‘সময়ের অন্যতম বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার।’

তবে এই ভান্ডার নিলামঘরের মঞ্চে ওঠার পর বিশেষজ্ঞগণ বিবিসির কাছে গুরুতর প্রশ্ন তুলে ধরেছেন, ভারতের পবিত্র অতীতের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই অমূল্য সম্পদ বাজারে তোলা কি নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য?

১৮৯৮ সালে ইংরেজ এস্টেট ম্যানেজার উইলিয়াম ক্ল্যাক্সটন পেপে বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনীর ঠিক দক্ষিণে পিপ্রহওয়ায় একটি স্তূপ খনন করেন। সেখানে তিনি এমন কিছু জিনিস খুঁজে পান যা প্রায় ২ হাজার বছর আগে খোদাই করে সংরক্ষণ করা ছিল।

ইতিহাসবিদেরা একমত যে তখন অবধি অক্ষত এই দেহাবশেষ বুদ্ধের নিজ গোত্র শাক্য এবং বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বৌদ্ধদের ঐতিহ্য। এই দেহাস্থির অবশেষ পরবর্তীতে থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমায়ের মতো বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যেখানে এগুলি আজও পূজিত।

‘বুদ্ধ্বের দেহাবশেষ কি কোনো পণ্য যে তা শিল্পকর্মের মতো বাজারে বিক্রি করা যায়?’ এই প্রশ্ন দিল্লিভিত্তিক শিল্পকলা ইতিহাসবিদ নমন আহুজার। তিনি বলেন, ‘আর যদি তা না যায়, তাহলে বিক্রেতা তা নিলামে তোলার নৈতিক অধিকার কীভাবে পায়?

উইলিয়াম পেপের প্রপৌত্র ক্রিস পেপে বিবিসিকে বলেন, তাঁর পরিবার দেহাবশেষ দান করার উপায় খুঁজছিল। কিন্তু তাতে নানান সমস্যা এসে হাজির হয়। তাই নিলামে তোলাকেই ‘বৌদ্ধদের কাছে এই দেহাবশেষ স্থানান্তরের সবচেয়ে ন্যায্য ও স্বচ্ছ উপায়’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

নিউইয়র্কে কর্মরত সোবেথিজের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ও হিমালয় অঞ্চলের শিল্পের বিক্রয় প্রধান জুলিয়ান কিং বিবিসিকে বলেন, নিলাম কর্তৃপক্ষ রত্নগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে।

‘যখন সোবেথিজে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বস্তু এবং সংগ্রহযোগ্য জিনিস বিক্রির জন্য আনা হয়, আমরা যথাযথভাবে তা যাচাইবাছাই করি, বিশেষ করে তা কতটা খাঁটি, এর উৎস, আইনি বাধ্যবাধ্যকতা এবং অন্যান্য বিষয়গুলো যা আমাদের নীতিমালা ও শিল্পকর্ম ও প্রত্নবস্তুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য,’ বলেন কিং।

লন্ডনের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যাশলে থম্পসন এবং কিউরেটর কোনান চিওং দুজনেই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় শিল্পকলা বিশেষজ্ঞ, তাঁরা আরও কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। বিবিসিকে একটি যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, ‘এই বিক্রিকে ঘিরে আরেকটি নৈতিক প্রশ্ন হলো; মানব দেহাবশেষ কি বাণিজ্যযোগ্য? এবং কে ঠিক করে দেবেন কোনটা দেহাবশেষ আর কোনটাই বা নয়? বিশ্বের বহু বৌদ্ধের কাছে বিক্রির জন্য তোলা রত্নগুলো এবং বুদ্ধের দেহাস্থি ও দেহভষ্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ।’

নিদর্শনগুলোকে বিক্রির জন্য তোলাকে ঘিরে বৌদ্ধ নেতৃত্বের মধ্যেও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।

‘বুদ্ধ আমাদের শিক্ষা দেন যে অনুমতি ছাড়া অন্যের সম্পদ দখল করা উচিত নয়।’ বিবিসিকে এই কথা বলেন লন্ডনভিত্তিক ব্রিটিশ মহাবোধি সোসাইটির অমল আবেওয়ার্দেনে। তিনি যোগ করেন, ‘ঐতিহাসিক দলিল বলছে শাক্য বংশকে এই দেহাবশেষের অভিভাবকত্ব দেওয়া হয়েছিল, কেননা বুদ্ধ তাঁদের সম্প্রদায় থেকেই এসেছিলেন। তাঁদের ইচ্ছা ছিল এই দেহাবশেষ রত্নসহ সংরক্ষিত থাকুক, যেন তা বুদ্ধভক্তবৃন্দ দ্বারা পূজিত হতে পারে।’

ক্রিস পেপে লিখেছেন এই রত্নগুলো তাঁর প্রপিতামহের এক ভাইয়ের হাত থেকে তাঁর এক চাচাতো ভাইয়ের হাতে আসে এবং ২০১৩ সালে তা তাঁর ও অন্য দুই চাচাতো ভাইয়ের হাতে এসে পৌঁছায়। তখন থেকেই তিনি তাঁর প্রপিতামহের আবিষ্কার নিয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন।

‘ভারতের ওপর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা আমার কাছে সাংস্কৃতিক লজ্জা ছিল এবং এখনো আছে। কিন্তু সেই সম্পদ শিকারীদের মধ্যেও এমন কিছু মানুষ ছিল যারা জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করেছিল।’ ক্রিস পেপের ভাষ্য।

তিনি বলেন, এই গবেষণা তাঁর পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে অনেককিছুই তুলে ধরছে যেগুলো তিনি একসময় ‘পুরনো যুগের সংস্কারাচ্ছন্ন ভিক্টোরিয়ান’ বলে মনে করতেন।

‘জানতে পেরেছি যে উইলিয়াম পেপের প্রথম স্ত্রী তাঁদের মধুচন্দ্রিমার জন্য ভারতের বিভিন্ন দিকে ঘুরতে চেয়েছিলেন এবং তিনি সেই দেশ ও এর সংস্কৃতি ভালোবাসতেন। দুর্ভাগ্যবশত এক অজ্ঞাত রোগে তিনি মারা যান। আমি জানতে পেরেছি যে আমার দাদী ভারতীয় নারীদের প্রতি জমি বিষয়ক আইনকানুন নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন।’

‘আমি আরো জানতে পেরেছি যে এই স্তূপ উৎখননের উদ্দেশ্য ছিল ১৮৯৭ সালের দুর্ভিক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করা।’

উইলিয়াম পেপে এই রত্নসহ দেহাবশেষ ও ভষ্মাধার ঔপনিবেশিক ভারত সরকারের কাছে তুলে দেন। এর ভেতর দেহাস্থি থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ রাজার (পঞ্চম রামা) কাছে, একটি পাথরের ঝাঁপি এবং অন্যান্য নিদর্শন কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম— তৎকালীন ইম্পেরিয়াল মিউজিয়াম অব ক্যালকাটাতে পাঠানো হয়।

শুধু অল্প ‘নকল অংশ’ যা পেপেকে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তা পেপের পরিবারের কাছে রয়ে যায়। সোথেবিজ জানায়, পেপেকে আনুমানিক এক-পঞ্চমাংশ প্রত্নবস্তু রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

সূত্রগুলো বিবিসিকে বলেছে, নিলামঘর এই ‘নকল’ নিদর্শনগুলো আসল বলেই মনে করে। এগুলোকে ভারত সরকার দানকৃত নিদর্শনগুলোর মধ্যে বাহুল্য মনে করেছিল এবং পেপেকে রাখার অনুমতি দিয়েছিল।

বিগত ছয় বছরে এই রত্নভান্ডার বিভিন্ন জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়েছে, যার ভেতর ২০২৩ সালের মেট-ও ছিল। পেপে পরিবারও একটি ওয়েবসাইট চালু করেছে ‘আমাদের গবেষণা ভাগ করে নেওয়ার’ জন্য।

কিছু বিশেষজ্ঞের মতে বুদ্ধের দেহাবশেষকে কখনোই বাজারি পণ্য হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়।

থম্পসন ও চিওং উভয়ের মতে, ‘সোবেথিজের এই নিলাম এই অত্যন্ত পবিত্র বস্তুগুলোকে বিক্রয়যোগ্য করে তুলেছে। ঔপনিবেশিক সহিংসতার ধারাবাহিকতায় এগুলোকে স্তূপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘রত্ন’ এবং ‘ইউরোপীয়দের আগ্রহের বস্তু’ করে তোলে, যার মধ্য দিয়ে দেহাস্থি ও দেহভষ্ম থেকে আলাদা করে তাঁদের পবিত্রতা থেকে আলাদা করে তোলে।’

ক্রিস পেপে বিবিসিকে বলেন, তিনি যেসব মঠে গেছেন সেখানে ‘কোনো বৌদ্ধই এগুলোকে বুদ্ধের দেহাবশেষ বলে মনে করেন না।’

পেপে যোগ করেন, ‘শুধু অল্প কিছু বৌদ্ধ গবেষক পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে জটিল, বাস্তবতা বিবর্জিত যুক্তি তুলে ধরেছেন, যেখানে তাঁরা দাবি করছেন যে এগুলোকে দেহাবশেষ বলা যেতে পারে। এটি এসব গবেষকদের বানানো, যা সাধারণ বৌদ্ধদের মধ্যে স্বীকৃত কোনো ব্যাখ্যা নয়’।

পেপে বলেন তাঁর পরিবার ‘মন্দির ও জাদুঘরে (দেহাবশেষ) দান করার খোঁজ নিয়েছে, কিন্তু তাঁরা সকলেই একেক রকমের সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছে।’ তাঁর মতে, ‘নিলামই মনে হচ্ছে এই নিদর্শনগুলো বৌদ্ধদের কাছে হস্তান্তরের সবচেয়ে নায্য ও স্বচ্ছ উপায়, এবং আমরা বিশ্বাস করি যে সোবেথিজ তা পারবে।’

কেউ কেউ কোহিনূরের দিকেও আঙ্গুল তোলেন, যা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লুঠ করেছিল এবং বর্তমানে তা ব্রিটিশ ক্রাউন জুয়েলের অংশ। বহু ভারতীয়ই একে চুরি বলে মনে করেন। বুদ্ধের রত্নগুলোর ক্ষেত্রেও কি তাই ঘটবে?

‘আমার মনে হয় না প্রত্যার্পন সবসময়েই খুব জরুরি’ আহুজা বলেন। ‘তবে, এমন দুর্লভ ও পবিত্র নিদর্শন যা একটি জনপদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে গড়ে তোলে, তা সরকারের বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে।’

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment