×

খালেদা জিয়ার পথচলার ফুল আর কাঁটা

আজ দেশের মাটিতে পা রেখেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, একজন দলনেত্রী। এটি কী হতে চলেছে বিএনপির রাজনীতির সম্ভাব্য নতুন অধ্যায়ের যাত্রা? এর আগে-পরে অনেকবার চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া আসা করেছেন তিনি। কিন্তু তিনি এবার ফিরে এলেন গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে। জানাচ্ছেন শতাব্দীকা ঊর্মি 

১৯৮১ সালের ৩০ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর আটপৌরে গৃহবধূ খালেদা খানম পুতুল জানতেন না তাঁর দুই ছেলে পিনো আর কোকোর কী হবে? সামনে তাঁর জন্য কী অপেক্ষা করছে। সদ্য স্বামী হারানো এই নারী তখনো ‘আপোষহীন নেত্রী’ খালেদা জিয়া হননি। তবে পরিস্থিতি ও বাস্তবতা ধীরে ধীরে তাঁকে খালেদা খানম থেকে খালেদা জিয়ায় পরিণত করেছে। তিনি ধরেছেন স্বামী জিয়াউর রহমানের গড়া রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের হাল।

কিন্তু খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক পথচলা কি মসৃণ ছিল?

কখনো জনতার উল্লাস, কখনো স্বৈরশাসকের জেল, কখনোবা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন, আবার মাঝেমধ্যে নিজের দলেই দ্বিধা-বিভাজন, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক পথচলায় এসবই ছিল যেন ফুল আর কাঁটা।

খালেদা জিয়া ১৯৮২ সালে বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। আশি থেকে নব্বই দশক অব্দি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের খালেদা জিয়ার আপোষহীন মনোভাব বিএনপির রাজনীতিকে নতুন দিশা দেয়। অতঃপর ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতনের পর যে নির্বাচন হয়, সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯১ সালে ১৯ মার্চ  গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হলেন এমন এক সময়ে, যখন নারীদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে দেখা যেত খুব কমই। তাঁর দৃঢ়তা, অহংকার, এবং অনেক সময় জেদই এগিয়ে নিয়েছে তাঁকে।

আসলে একজন খালেদা জিয়ার গল্প কেবল রাজনীতির জটিল কাহিনি নয়। তাঁর একটি মানবিক অধ্যায়ও রয়েছে। মা হিসেবে তিনি ছেলে পিনো, মানে আজকের তারেক রহমানের অসুস্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন থেকেছেন প্রতিনিয়ত। এখনও পর্যন্ত তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। ছেলে কোকো, অর্ফাাৎ আরাফাত রহমান ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রবাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, যা ছিল তাঁর জীবনের আরেক বড় আঘাত।

তিনি কারাগারে থেকেছেন দীর্ঘ সময়। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। ৩০ অক্টোবর একই মামলায় হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার নিম্ন আদালতের দেওয়া ৫ বছরের সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন।

২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুক্ত হন তিনি। হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতি আবারও পুনরুজ্জীবিত হয়।

এর আগে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি গ্রেপ্তার হন। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের আদেশে মুক্তি পান।

 

এর আগে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর আটক হন তিনি। এর মধ্যে প্রথম দুবার ঘটনাস্থল থেকে আটক করে তাঁকে বাসায় পৌঁছে দেয় পুলিশ। ১৯৮৭ সালে হোটেল পূর্বাণীতে এক অনুষ্ঠান থেকে আটক করে আরও কয়েকজন নেতার সঙ্গে তাঁকে কিছু সময়ের জন্য মতিঝিল থানায় নেওয়া হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ‘অঘোষিত’ভাবে তাঁকে গৃহবন্দী থাকতে হয়েছে। তবে এটা আইনানুগ ছিল না। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সময় ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর গুলশানের বাসায় তাঁকে অবরুদ্ধ করা হয়। আর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি তাঁর গুলশানের কার্যালয়ের দুই পাশে বালুর ট্রাক রেখে বাসা থেকে তাঁর বেরোনোর পথে বাধা সৃষ্টি করা হয়। এ সময় ৯৩ দিন অবরুদ্ধ ছিলেন তিনি।

খালেদা জিয়া, যখন বিচারাধীন অবস্থায় হাসপাতালে শয্যাশায়ী, তখন তিনি আর সেই আগ্রাসী নেত্রী নন—তিনি একজন মা, একজন মানুষ। এই শোক, দূরত্ব, এবং রাজনৈতিক জটিলতার মধ্যে থেকেও তিনি কখনো প্রকাশ্যে আবেগ দেখাননি। তবে তাঁর নিরবতা সব বলে দেয়।

রাজনীতি হয়তো তাকে শক্ত করেছে, কিন্তু ব্যক্তিগত শোক, বন্দীত্বের নির্জনতা আর সহ্যশক্তি তার আত্মশক্তিকে দৃঢ় করেছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে এক ব্যতিক্রমী সময় এসেছিল, যখন বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা-এই তিন দেশের শীর্ষপদে ছিলেন নারী সরকারপ্রধান। খালেদা জিয়া, বেনজির ভুট্টো ও চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা—তাঁদের যুগপৎ নেতৃত্ব ছিল নারী নেতৃত্বের এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। প্রথমে রাজনীতিতে আসতে না চাইলেও খালেদা জিয়া নারী নেতৃত্বের আইকন হিসেবে উঠে আসেন। তিনি জাতীয় রাজনীতিতে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিলেন। রাজনীতির ময়দানে রয়েছে তাঁর এক দীর্ঘপদচারণ।

খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন শক্তিশালী নারী নেত্রী। একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া এই নেত্রী ছিলেন সেনানিয়ন্ত্রিত রাজনীতি থেকে গণতন্ত্রের উত্তরণকালে বিএনপির আলোচিত-সমালোচিত মুখ। তাঁর নেতৃত্বে দেশ দেখেছে মুক্তবাজার অর্থনীতি, বেসরকারিকরণ, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার ঘূর্ণি।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে তার রাজনৈতিক ক্ষমতা শুধু দমন নয়, নিঃসংশয়ভাবে ক্ষীণ হয়েছে। যার কারণ ছিল বিচারিক বাধা, শারীরিক অসুস্থতা, এবং দীর্ঘকালীন গৃহবন্দীত্ব।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির যাত্রা ছিল এক সময় প্রবল, আবেগঘন এবং জনপ্রিয়তার জোয়ারে পূর্ণ। সেই দল এখন দাঁড়িয়ে আছে এক অনিশ্চিত, ছায়াপথে—যেখানে নেতৃত্বের প্রশ্ন, প্রজন্মের বিভাজন, ও রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা মিলেমিশে দলটিকে করেছে দুর্বল ও দ্বিধান্বিত। অভ্যুত্থান পরবর্তী দেশে দলটির মোড় কি আবারও ঘুরবে খালেদা জিয়ার হাত ধরে? এই সন্ধিক্ষণে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি জ্যোতির মতো নাকি ছায়ার মতো?

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment