অর্থনীতি বদলে দেওয়া পোশাক শিল্পে শঙ্কা
একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতির শঙ্কা, অন্যদিকে স্বৈরাচার পতনের পর সৃষ্ট রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে দেশের পোশাক খাত ও সামগ্রিক অর্থনীতি পড়েছে গভীর উদ্বেগের মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক সাময়িকভাবে স্থগিত থাকলেও, সেই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন লাখ লাখ পোশাক শ্রমিক। এ অবস্থায় বিদেশি বাজারে প্রতিযোগিতার চাপ, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য আগামী দিনগুলোকে আরও কঠিন করে তুলছে। এসব নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত অ্যালেক্স ট্রাভেলি ও সাইফ হাসনাতের প্রতিবেদনটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন রাতুল আল আহমেদ।
বাংলাদেশের জন্য বছরটি কঠিন হওয়ারই ছিল। গত বর্ষায় চলমান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেই আন্দোলনকারীরা এক স্বৈরাচারী শাসককে গদি থেকে হটিয়ে দেশকে ‘অস্থিতিশীলতার’ দিকে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশের নতুন সরকার যখন দেশটির অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এমন সময় মাসখানেক আগে এক ভয়ানক খবর এলো। যুক্তরাষ্ট্র দেশটির সব পণ্যের ওপর নতুন করে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। বাংলাদেশ জ্বালানি, খাবার এবং অন্যান্য দরকারি পণ্য কেনার জন্য রপ্তানি আয়ের ওপর নির্ভরশীল।
যদিও দুনিয়াজুড়ে প্রতিক্রিয়ার মুখে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্রুতই বাংলাদেশসহ আরও অনেক দেশের ওপর থেকে সেই শুল্ক সাময়িকভাবে স্থগিত করেন। তবে এই শুল্ক আবার চালু করা হতে পারে ভেবে আতঙ্কিত বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা। তাঁদের জীবনযাপন এই খাতের ওপর নির্ভর করে আছে।
উত্তরবঙ্গ থেকে আসা ২৫ বছর বয়সী মুরশিদা আখতার বর্তমানে ঢাকার কাছেই বসবাস করছেন। পাঁচ বছর ধরে কারখানায় সেলাই মেশিনে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। কিছুদিন আগে তিনি এবং আরও ২০০ শ্রমিক, যাঁদের ৭০ শতাংশ মহিলা, সাভারের শিল্প এলাকার ফোরএ ইয়ার্ন ডাইং নামে একটি কারখানায় যোগ দেন।
শুল্ক নিয়ে চিন্তিত থাকলেও চাকরি বদলানোর সুযোগ পেয়ে মুরশিদা বেশ খুশি। তাঁর আশা, নতুন চাকরিতে তিনি মাসে ১৯০০০ টাকা (১৫৬ ডলার) বেতন পাবেন, যা আগের চেয়ে একটু বেশি। তা ছাড়া নতুন কারখানা বেশ কাছেই এবং কাজের পরিবেশও ভালো।
মুরশিদা বলেন, ‘আমার চিন্তা হচ্ছে, অর্ডার কমে যাবে। তাহলে কাজও কমে যাবে।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসন অঙ্গরাজ্যের সমান আয়তনের বদ্বীপে অবস্থিত বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ গাদাগাদি করে বাস করে। ১৯৭০-এর দশকে সহিংস সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে ব্যর্থ বলে মনে করা হতো। তবে ১৯৮০-এর দশক থেকে পোশাকশিল্পের ওপর ভর করে দেশটি ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে গেছে। দেশটির পোশাক শ্রমিকেরা, বিশেষত মহিলারা দেশটিকে দুনিয়াজুড়ে ‘সেলাই দিদিমণি’ হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে। ফলাফল হিসেবে আজ বাংলাদেশি নাগরিকেরা প্রতিবেশী ভারতের নাগরিকদের চেয়ে স্বচ্ছল জীবনযাপন করছে।
বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক সরাসরি রপ্তানির জন্য পোশাক তৈরি করেন। মুরশিদা তাঁদের একজন। তাঁর ওপর স্বামী, ছেলেসহ কয়েকজন মানুষ নির্ভরশীল। তাঁর মতো অন্যান্য শ্রমিকের ওপরও চার থেকে পাঁচজন নির্ভরশীল মানুষ রয়েছে।
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত এই শুল্ক এবং এর পাশাপাশি চীনা পণ্যের ওপর আরোপিত ১৪৫ শতাংশ শুল্ক বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির এই চাকাকে থামিয়ে দিতে পারে।
সাময়িকভাবে অতিরিক্ত শুল্ক স্থগিত করার আগে বাংলাদেশের অন্তর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ট্রাম্পকে চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি ৯০ দিনের জন্য স্থগিতের অনুরোধ করেন। মুহাম্মদ ইউনূস কথা দেন যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও তুলা ও অন্যান্য পণ্য কিনবে, যাতে ছয় বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর অবশ্য এত নরম সুরে কথা বলতে রাজি নন। তাঁর মতে, এই শুল্ক হুমকি ‘ক্ষমতার কুৎসিত প্রদর্শন’। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ওপর এই হুমকি ঠিক তখনই এলো, যখন দীর্ঘদিনের ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধির পর দেশটি মন্দার মুখে পড়ে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে।
২০২৪ সালের তারল্যসংকট হাসিনা সরকারের টানা ১৫ বছরের শক্ত মুঠোর বাঁধন আলগা করে ফেলেছিল। হাসিনার অপসারণ দেশে তাতক্ষণিকভাবে নিরাপত্তা সংকট তৈরি করেছিল। ৯ মাস পরেও বাংলাদেশ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কোনো পরিকল্পনা দেখাতে পারেনি।
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ৮৫ শতাংশই পোশাক, যার একটি বড় অংশ আবার যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। ট্রাম্প জুলাইয়ে ৯০ দিনের স্থগিতাদেশ শেষে যদি ৩৭ শতাংশ শুল্ক ফিরিয়ে না-ও আনেন, তবুও বাংলাদেশকে ১০ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হতে হবে। ট্রাম্প প্রায় সব দেশের ওপর এই শুল্ক আরোপ করেছেন।
কিন্তু এই ১০ শতাংশ শুল্কও পোশাক শিল্পের মতো যেসব ব্যবসায় লাভের পরিমাণ খুবই কম, পরিস্থিতি কঠিন করে তুলতে পারে। চীনের মতো সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক দেশের পাশাপাশি প্রতিযোগিতা করতে হবে ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বা শ্রীলঙ্কার মতো দেশের সঙ্গেও।
বাংলাদেশের রাজনীতির পটপরিবর্তনকে পশ্চিমা উদার গণতন্ত্রের সমর্থকরা আশার আলো হিসেবে দেখছেন। আবার ভারত হাসিনা সরকারের সঙ্গে যে কৌশলগত জোট গড়ে তুলেছিল, তার পতনে উদ্বিগ্ন। কিন্তু সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রশাসন ড. ইউনূসকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হাসিনার আমলে ঘটা আর্থিক লুটপাটের যে প্রভাব দেখা দিয়েছে, তা মোকাবিলার চেষ্টা করছে। ব্যাংক মনে করছে, প্রবৃদ্ধি আপাতত কিছু কমবে, তবে ২০২৬ সালের মধ্যে ব্যবসার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। শুল্ক আরোপ সেই আশায় জল ঢেলে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ইতিমধ্যে বাংলাদেশের আগামী দুই বছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে দিয়েছে।
দেশটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপের মধ্যেও রয়েছে, যারা গত বছর ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ মঞ্জুর করেছিল।
ঢাকার থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘আমরা আইএমএফের পক্ষ থেকে ভর্তুকি কমিয়ে জ্বালানির মূল্য বাড়ানোর বিরাট চাপের মধ্যে আছি।’
১০ শতাংশ শুল্ক এবং ভবিষ্যতে আরও শুল্কের আশঙ্কা এমন এক শিল্পের ওপর আঘাত করেছে, যা নিজের খোলনলচে বদলে ফেলেছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ১১০০-এর বেশি শ্রমিক মারা যান। এই মর্মান্তিক প্রাণহানিতে বিদেশি ক্রেতারা, বিশেষত পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের ওপর আস্থা হারাতে শুরু করে।
তবে এই পোশাক শিল্প টিকে থাকার জন্য নিজেকে বদলাতে শিখেছে। ঢাকা থেকে সাভারে যাওয়ার পথে যেখানে একসময় রানা প্লাজা ছিল, সেখানে এখন এক বিরাট ডোবা। এই ভয়ংকর অতীত থেকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ভবিষ্যতে কী করবে, তার পথ খুঁজে নিয়েছে।
বর্তমানে পোশাক শিল্প আরও সংগঠিত হয়ে উঠেছে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমে গেলেও রপ্তানি মূল্য ও কর্মসংস্থান বেড়েছে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন (এলইইডি) সনদপ্রাপ্ত ২৩০টি পোশাক কারখানা রয়েছে, যা কিনা বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি।
এই কারখানাগুলোর একটি হলো ফোরএ ইয়ার্ন ডাইং, যেখানে মুরশিদা আখতার কাজ করেন। নামের মধ্যে ‘ডাইং’ থাকলেও বহু বছর ধরেই তারা সুতা রং করে না। তারা এখন ওয়াটারপ্রুফ, চেইন দেওয়া জ্যাকেটের মতো দামি পোশাক বানায়। তাদের ক্রেতাদের তালিকায় কারহার্ট থেকে শুরু করে কেলভিন কেইনের মতো মার্কিন ব্র্যান্ড রয়েছে, তবে তাদের ইউরোপের গ্রাহকই বেশি।
সরেজমিনে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের চেইনশপ কসকোর জ্যাকস নিউইয়র্ক সিরিজের পোশাক তৈরির জন্য ফোরএ ইয়ার্ন ডাইংয়ের পাঁচতলাজুড়ে কারখানাটির শ্রমিকেরা কাপড় কাটা ও সেলাই ফোঁড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত। দেয়ালে লাগানো বিশাল ফ্যানগুলো সেলাই মেশিনের একটানা খট খট আওয়াজের সঙ্গে গুনগুন করে চলছে। আলো-বাতাস চলাচলের সুব্যবস্থা আছে, এমনকি সাভারের ভ্যাপসা গরমেও কাজের পরিবেশ ভালো।
কারখানার ভেতরের সাইনবোর্ডগুলো প্রথমেই ইংরেজিতে লেখা, এরপর বাংলায়। বাংলাদেশের অন্যান্য কারখানার মতোই এখানে বিদেশি পরিদর্শকদের চোখের জন্য আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছে।
কারখানার বাইরের অংশ সবুজ লতায় ছাওয়া। ছাদে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল রয়েছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কারখানাটি চালাতে সাহায্য করে।
গত আগস্টে হাসিনার পতনের সময় এই কারখানাটিও হামলার শিকার হয়। জেনারেল ম্যানেজার খন্দকার ইমাম গর্বভরে বলেন, এরপরেও কীভাবে তাদের কারখানা চালু ছিল।
দেশের আরও বহু কারখানার মতো তাঁর কারখানার বাইরেও মব জড়ো হয়েছিল। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই হাসিনা-সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ জেগে উঠেছিল জনমনে। খন্দকার ইমাম বলছেন, প্রায় এক হাজার লোক এসেছিল কারখানায় হামলা চালাতে। এই উন্মত্ত জনতার রোষ সামাল দিতে তিনি হেলমেট মাথায় শ্রমিকদের নিয়ে গেটে দাঁড়ান।
যদিও শেষ পর্যন্ত কেউ গুরুতর আহত হননি এবং এক দিনের জন্যও উৎপাদন বন্ধ হয়নি। খন্দকার ইমামের মতে, তাঁর কারখানাটি তাঁর দেশের মতোই জীবন-মরণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় অভ্যস্ত।
কোম্পানিটির টেকসই উন্নয়নপ্রধান মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দেশের পুরো অর্থনীতি এই খাতের ওপর নির্ভরশীল। হাসিনাবিরোধী আন্দোলনকারীরাও তা বোঝে। আমাদের কাছে শ্রম ছাড়া আর আছেই-বা কি।’
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment