শাহজাহান-মমতাজ: যেই প্রেম বদলে দিয়েছিল ভারতের চেহারা
সৈকত আমীন
এই নশ্বর পৃথিবীতে বহুবার ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়েছে প্রেম। তবে কোনো বিয়ের ফলে একটা বিশাল অঞ্চলের চেহারা বদলে যাওয়ার ঘটনা ইতিহাসে খুব বেশি নেই। এমনটাই ঘটেছিল আজ থেকে ৪১৩ বছর আগে। মুঘল সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজ মহলের বিয়ের মধ্য দিয়ে। মুঘল সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজ মহলের বিয়ে শুধু একটি প্রেমের পরিণতি নয়—এটি হয়ে উঠেছিল এক ভূখণ্ডের প্রতীকি পরিচয়। এই বিয়ের ফলেই জন্ম হয়েছিল এমন এক স্থাপনার, যা আজও বিশ্বের চোখে ভারতের সৌন্দর্য, ঐতিহ্যের চিহ্ন বহন করে চলছে। তাজমহল সেই স্থাপনার নাম।
১৬১২ সালের ১০ মে, আগ্রায় রাজকীয় আড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল মুঘল যুবরাজ খুররম (পরবর্তীতে শাহজাহান) ও আরজুমান্দ বানু বেগমের (মমতাজ মহল) বিয়ে। এটি ছিল শাহজাহানের তৃতীয় বিয়ে, তবে প্রথম প্রেমের বিয়ে। এর আগে রাজনৈতিক সমঝোতায় তিনি পারস্যের রাজকন্যা কান্দাহারি বেগম এবং ইজ্জ-উন-নিসা বেগমকে বিয়ে করেছিলেন। তবে মমতাজের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন—ভালোবাসা, সান্নিধ্য ও নির্ভরতার।
এই দম্পতির প্রথম দেখা হয়েছিল বিয়েরও ৫ বছর আগে। মুঘল সাম্রাজ্যে মীনা বাজার নামে এক বিশেষ বাজার ছিল। পারস্যের নববর্ষ নওরোজ উদযাপন কেন্দ্র করে ৫ থেকে ৮ দিনের জন্য আয়োজিত হত সেই বাজার বা মেলা। সেই মেলায় আয়োজিত হতো কেবল নারীদের জন্য, মুঘল সম্রাট ও কয়েকজন রাজকুমার ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। সেই বাজারেই প্রথম দেখা হয়েছিল এই দম্পতির।
তখন শাহজাহান ছিলেন ১৫ বছরের কিশোর, আর মমতাজ ১৪ বছরের কিশোরী। পারিবারিক আত্মীয়তার সূত্র ধরে পরিচয়, আর সেই পরিচয় রূপ নেয় গভীর প্রেমে। বিয়ের পর মমতাজ শুধু সম্রাজ্ঞী ছিলেন না, বরং ছিলেন শাহজাহানের পরামর্শদাতা, সহচর ও আত্মিক সঙ্গী। যুদ্ধের ময়দানেও মমতাজ ছিলেন তার পাশে, রাজ্যশাসনের আলোচনাতেও ছিলেন সমান সক্রিয়।
তাদের দাম্পত্যজীবন ছিল এক যুগল সংলাপ, যেখানে প্রেম ও রাষ্ট্রনীতি হাত ধরাধরি করে চলেছিল। কিন্তু সে সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৬৩১ সালে, ১৪তম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে, মাত্র ৩৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন মমতাজ।
সেই মৃত্যু ভেঙে দিয়েছিল শাহজাহানকে। তিনি নিঃসঙ্গ, নিঃস্ব হয়ে পড়েন। প্রিয়তমার স্মরণে তাই তিনি গড়েন এক মৃত্যুর সৌধ, যার ভিতরে রয়ে গেছে অশ্রু, প্রেম, এবং এক চিরন্তন অভিশাপের সৌন্দর্য—তাজমহল।
তাজমহল আজ ভারতের প্রতীক, কিন্তু এর নির্মাণকাজ ছিল এক ব্যয়বহুল ও শ্রমনির্যাতনমুখর প্রক্রিয়া। ২২ বছর ধরে ২০ হাজার শ্রমিক ও কারিগরকে অমানবিক পরিশ্রমে নিয়োজিত রাখা হয়। এই প্রকল্পে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, যা সাম্রাজ্যের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তোলে। অতিরিক্ত কর আদায়ের ফলে সাধারণ মানুষ দারিদ্র্যে জর্জরিত হয়। জনশ্রুতি আছে, নির্মাণ শেষে কারিগরদের হাত কেটে ফেলা হয়েছিল—যদিও এই দাবির ঐতিহাসিক ভিত্তি দুর্বল, তবুও এটি শ্রমশোষণের প্রতীক হিসেবে রয়ে গেছে জনচেতনায়।
কিন্তু এসব করুণ বাস্তবতার ছায়া পেরিয়ে তাজমহল হয়ে উঠেছে এক ভালোবাসার প্রতীক, যা পার করেছে দেশ-কাল-জাতির সীমা। এটি ভারতকে দিয়েছে এক আন্তর্জাতিক চেহারা—যেখানে প্রেম, কষ্ট, রাজনীতি ও শিল্পের সংমিশ্রণ বিশ্ববাসীর সামনে ভারতের নতুন পরিচয় হয়ে উঠেছে।
মমতাজ-শাহজাহানের বিয়ে তাই কেবলই এক রাজপ্রেম নয়; এটি ইতিহাসের গর্ভে জন্ম নেওয়া এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব—যার স্মৃতি আজও জ্বলজ্বল করছে আগ্রার ধবধবে মার্বেল গায়ে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment