১২ই মে অঞ্জন দত্তের মালার জন্মদিন, নাকি হারিয়ে ফেলার দিন
আজ ১২ই মে। এই তারিখ এলেই অঞ্জন দত্তের ‘মালা’ গানের কথা মনে পড়ে যায় আমাদের। মনে প্রশ্ন জাগে, কে এই মালা? আজ কি তাঁর জন্মদিন! নাকি মালা-অঞ্জনের বিচ্ছেদের দিন! উত্তর খুঁজেছেন গৌতম কে শুভ
‘এই ১২ই মে তুমি চলে গিয়েছিলে
জীবন থেকে আমার।‘
গায়ক, পরিচালক কিংবা অভিনেতার বাইরে গিয়ে যদি অঞ্জন দত্তের দিকে তাকালে দেখতে পাই, অঞ্জন যেন নিজের জীবনের গল্প বলে আমাদের সবার গল্পকেই ছুঁয়ে যাচ্ছেন।
অঞ্জন দত্তের গানে আমরা অনেক চরিত্রের দেখা পাই। যাদের অধিকাংশই নারী। কখনো রঞ্জনা, কখনো বেলা বোস, মালা, ম্যারি এন কিংবা ববি রায়। এদের মধ্যে বেলা বোস আর মালা চরিত্র হিসেবে বেশি জনপ্রিয়।
‘মালা’ গানটাতে আজকের এই দিন, ১২ই মে’র কথা বলা আছে। দিনটা এলেই অঞ্জন-ভক্তরা যেন অসহায় হয়ে শোনেন, ‘তোমার জংলা পাড়ের ঢাকেশ্বরী শাড়ি। তোমার পিসি চন্দ্রের ঝুমকো কানের দুল’। গান বাজতে থাকে মুঠোফোনে, মগজে, মনখারাপে।
১৯৯৬ সালে অঞ্জন দত্তের ৩য় অ্যালবাম ভালোবাসি তোমায় এর মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ‘মালা’র। কিন্তু সেই পরিচয় শেষ হয় না কখনও। কারণ এই চরিত্রের পেছনে রয়েছে এমন এক রহস্য, যা এখনও শ্রোতাদের ভাবায়, কাঁদায়, খুঁজে ফেরায়। কাকে ভেবে লিখেছিলেন অঞ্জন এই গান!
পিটারের মারি-ক্লেয়ার থেকে অঞ্জনের মালা
জেনে হয়তো অনেকে অবাক হবেন, এই বিখ্যাত গানটির সুর অঞ্জনের নয়। পিটার সারস্টেডের ১৯৬৯ সালের বিখ্যাত গান ‘হোয়্যার ডু ইউ গো টু (মাই লাভলি)?’এর সুরে এই গান বেধেছিলেন অঞ্জন। বিভিন্ন সময় অঞ্জন দত্ত জানিয়েছেন, এটা পিটারের গানের বাংলা সংস্করণ। শুধু সুরই নয়, গানের কথাও। এই গানে মুলত মারির নাপোলির (নেপলস) জীবন মিশেছে মালার শহর কলকাতায়।
মালা গানে মূল গানের সাদৃশ্য ও রহস্য দুই-ই পাওয়া যায়। যেমন অনেকে মনে করেন, পিটারের গানটি ছিল ইতালির অভিনেত্রী সোফিয়া লোরেনকে নিয়ে। আবার কেউ বলেন গানটির অনুপ্রেরণা ছিলেন ডেনমার্কের গায়িকা ও অভিনেত্রী নিনা ভ্যান।
গানটির অঞ্চন সংস্করণ নিয়েও এমন আলোচনা হয়েছে অনেক। বিশেষ করে তিনি কাকে ভেবে এই গান লিখেছিলেন! নানা মত ও যুক্তি পাওয়া যায় এখানে। অনেকেই জোর দিয়ে বলেন অঞ্জনের মালা চরিত্রের পেছনে ছিলেন মুনমুন সেন।
মারির বাঙালি ছায়া এই মালা
ইতালির মারি গরিব ঘর থেকে উঠে এসেছেন প্যারিসের বড়লোকি মহল্লায়। তাঁর চলনে-বলনে কিংবা পোশাকে দেখা যেত চমক। মালাও এমন। তাঁর কথায় মধুবালার মতো মিষ্টতা, চোখে অপর্ণা সেনের অভিমান, আর চলনে সোফিয়া লরেন। যিনি বেছে নেন ফরাসি দামি সুগন্ধি।
গান, সাহিত্য, সিনেমায় এমন ছায়াময় চরিত্র নতুন কিছু নয়। কখনো তারা সত্যের ছায়া, কখনো কল্পনার গন্ধ মেশানো বাস্তব। অঞ্জন দত্ত এসব প্রসঙ্গে কখনই মুখ খোলেননি। হয়ত ইচ্ছে করেই। যাতে এই গান শুনলে শ্রোতার ভাবনায় তাঁর জীবনের এমন চরিত্র সহজেই মাথায় ঢুকে যেতে পারে।
মালার জন্মদিন নাকি বিচ্ছেদের দিন
যতবারই ১২ই মে আসে, ভক্তদের বেশীরভাগই ভেবে বসেন আজ মালার জন্মদিন। ‘জন্মদিনের তোড়া তোড়া ফুল’ লাইনটি থেকে এমন ভাবনা আসা স্বাভাবিক। আবার বছর খানেক আগে এই তারিখে ঢাকায় অঞ্জন গাইতে এলে, সেখানে কেক কেটে মালার জন্মদিন পালন করা হয়।
আবার কেউ কেউ দিয়েছেন অন্যরকম যুক্তি। তাঁদের ভাষ্য, কলকাতা শহরের একটি ফুলের দোকানের নাম ‘জন্মদিন’। সেই দোকান থেকেই ফুল এসেছেছিল মালার বিয়েতে। কিংবা মালার হারিয়ে যাওয়ার দিনে প্রেমিকের ব্যর্থ ভালোবাসাকে উস্কে দিতে ফুল এসেছে পুরোনো প্রেমিকের কাছে।
মালা কি আসলেই বাস্তব কেউ?
সাজ্জাদ হুসাইন এর অঞ্জনযাত্রা বইতে (অঞ্জন দত্তের আত্মকথন) মালার কোনও উল্লেখ নেই বললেই চলে। এই বইয়ে অঞ্জন নিজের জীবন নিয়ে খোলাখুলি সবই বলেছেন। কিন্তু মালা সেখানে অনুপস্থিত। এই অনুপস্থিতিই মালাকে আরো রহস্যময় করেছে।
মালা কি একজন যৌনকর্মী হতে পারেন? অঞ্জন দত্তকে এই প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, হতে পারে। এই ‘হতে পারে’ অর্থ শ্রোতারা যেন তাঁর নিজের মত করে মালাকে কল্পনা করতে পারে। সেই মালা, যিনি গান হয়ে থাকেন, স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকেন শ্রোতার মনে।
অঞ্জন ভক্তদের কাছে মালা যেন এক তীব্র প্রেমের স্মারক, এক নস্টালজিয়ার নাম। হয়ত তিনি অঞ্জনের জীবনের কোনো বাস্তব নারী। অথবা একাধিক অভিজ্ঞতার সমষ্টিতে গড়ে ওঠা চরিত্র। কিংবা পিটারের গানের সূত্র ধরে অঞ্জনের গীতিতে ঢুকে পড়া কেউ।
মালা আসলে কে? আমরা হয়ত কোনোদিন এই প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তর পাব না।। তবুও প্রতি বছর এই দিনটায় গানটি ফিরে আসবে আমাদের কাছে। আমরা জানি না মালা কার বাস্তব ছায়া, নাকি তিনি নিছকই কল্পনার কেউ। হয়ত তিনি মুনমুন সেন, হয়ত নন।
ঠিক এই রহস্যই মালা গানকে বাঁচিয়ে রাখবে। তিনি আছেন, কারণ তিনি অনুপস্থিত। তিনি ধরা দেন, কারণ তিনি অধরা।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment