×

বাউলসুর থেকে জাতীয় সংগীত: ‘আমার সোনার বাংলা’র ইতিহাস

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’—শুধু একটি গান নয়, এটি আমাদের আবেগ আর আত্মপরিচয়ের অংশ। এই গান ঘিরে রয়েছে নানা বিতর্ক; সেটি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক—সব দিকেই। রয়েছে সুরের উৎস, স্বত্ব আর স্বীকৃতির প্রশ্ন। বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে লেখা গান কেমন করে হয়ে উঠল বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত? এই গানের গড়ে ওঠা, রূপান্তর ও স্বাধীনতা-পরবর্তী রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত—এসবের দিকে ফিরে তাকিয়েছেন গৌতম কে শুভ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতবিতান’-এর ‘স্বদেশ’ অংশের প্রথম গানটাই ‘আমার সোনার বাংলা’। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগ (প্রজাতন্ত্র)-এর ৪ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা”র প্রথম দশ চরণ।’

গানটির জন্ম ছয় দশকেরও বেশি আগে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন এই ‘বাউলাঙ্গের গান’ লিখেছিলেন, তখন তাঁর বয়স ৪৪ বছর। গানটির সুর পেয়েছিলেন কুষ্টিয়ার গগন হরকরার কাছে। তবে গগন এই সুর প্রচলিত বাউল গানের সুর থেকে পেয়েছিলেন কিনা, সেটি জানা যায়নি।

রবীন্দ্রনাথের বাউলাঙ্গের গান কী

‘বাউল গান’ আর ‘বাউলাঙ্গের গান’ কিন্তু এক নয়। বাউল গানের ছায়া যে গানে পাওয়া যায়, সেগুলোই বাউলাঙ্গের গান। এখানে ‘ছায়া’ বলতে মূলত বাউল গানের সুরের ছায়াকে বোঝানো হয়। কোনো গানের কথা বা দর্শনে বাউল ভাব থাকলেও, যদি সুর ধ্রুপদী সংগীতের মতো হয়, তাহলে সেটাকে আর ‘বাউলাঙ্গের গান’ বলা যাবে না।

রবীন্দ্রনাথ বাউল গানকে ভেঙে বেশ কিছু বাউলাঙ্গের গান লিখেছিলেন। সেসব গানের সুর, কথা কিংবা গঠন বাউল গানের মতো হলেও, মূল বাউল গানের যে ভাবনা বা দর্শন, সেখান থেকে এগুলো একেবারেই আলাদা। বাউল গানের ভাব অনেক গভীর, কিন্তু সুর সহজ। এই সহজ সুরের জন্যেই কিন্তু গ্রামের সাধারণ মানুষও বাউল গানের ভাব অনেকাংশেই বুঝতে পারে, অনুভব করতে পারে।

‘আমার সোনার বাংলা’র সুর রবীন্দ্রনাথ কীভাবে পেলেন

খালি পায়ে, এক হাতে বর্শা আর মাথায় ছোট একটা ঘণ্টা। লণ্ঠন হাতে পিঠে চিঠিপত্রের ঝুলি নিয়ে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ অঞ্চলে ছুটে বেড়াতেন একজন ডাকপিয়ন, নাম গগন হরকরা। ডাকহরকরার কাজ করতেন বলে নামের সঙ্গে হরকরা শব্দটি জুড়ে যায়।

গগন কুষ্টিয়ার শিলাইদহ পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন। বাকি সময় গান লিখতেন আর গাইতেন। বাউল গান। কাজের সুবাদেই রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে গগনের যাতায়াত ছিল। গগন গাইতেন তাঁর নিজের গান, ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।’

রবীন্দ্রনাথের ভালো লেগে যায় গগনের গান। বাউল গানের প্রতি তাঁর অনুরাগ তৈরি হয়েছিল শিলাইদহে এসেই। তাঁর অনেক লেখায় এই ভালোবাসার কথা এসেছে। শিলাইদহে থাকার সময় প্রায়ই বাউলদের সঙ্গে তাঁর দেখা আর কথাবার্তা হতো।

এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন্ এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে।’

‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানটি প্রথম ছাপার অক্ষরে আসে ‘প্রবাসী’-এর বৈশাখ ১৩২২ সংখ্যায়। হারামণি নামের একটি লেখায়। সেখানে উল্লেখ আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গানটি সংগ্রহ করেছিলেন শিলাইদহের পোস্ট অফিসের ডাক হরকরা গগনের কাছ থেকে। অবশ্য এরও আগে ‘ভারতী’-এর ১৩০২ সালের ভাদ্রসংখ্যায় সরলা দেবীর রচনায় ‘লালন ফকির গগন’ নামে একটি নিবন্ধ পাওয়া যায়।

সরলা দেবী তাঁর ‘জীবনের ঝরাপাতা’ বইতে এই বিষয়ে লিখেছিলেন, ‘কর্তাদাদামহাশয় চূঁচড়ায় থাকতে তাঁর ওখানে মাঝে মাঝে থাকবার অবসরে তাঁর বোটের মাঝির কাছ থেকে অনেক বাউলের গান আদায় করেছিলুম। যা কিছু শিখতুম তাই রবিমামাকে শোনাবার জন্যে প্রাণ ব্যস্ত থাকত। তাঁর মত সমজদার আর কেউ ছিল না। যেমন যেমন আমি শোনাতুম – অমনি অমনি তিনি সেই সুর ভেঙ্গে, কখনো কখনো তার কথাগুলিরও কাছাকাছি দিয়ে গিয়ে একখানি নিজের গান রচনা করতেন। কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, আমার সোনার বাংলা প্রভৃতি অনেক গান সেই মাঝিদের কাছ থেকে আহরিত আমার সুরে বসান।’

কিন্তু আরেকটি সূত্র থেকে এই গান সংগ্রহের ইতিহাস অন্য রকমভাবে পাওয়া যায়। প্রশান্তকুমার পালের ‘রবি জীবনী’ তৃতীয় খণ্ডে (প্রথম সংস্করণ ১ বৈশাখ ১৩৯৪, পৃষ্ঠা ১২৯) লিখিত তথ্যানুসারে জানা যায়, ১৮৯০ সালের ২৫ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ পরিবারসহ শিলাইদহে আসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, মেয়ে বেলা, ছেলে রথীন্দ্রনাথ, মৃণালিনীর এক বান্ধবী এবং বলেন্দ্রনাথ। ওই সময় তাঁরা সবাই মিলে একটি বড় নৌকায় (বোটে) থাকতেন, সেখানে পরিবারসহ থাকা যেত। প্রতিদিন স্থানীয় কিছু গায়ক এসে তাঁদের গান শোনাতেন। গানের জন্য এঁরা দুই আনা করে পারিশ্রমিক পেতেন। এই সময় বলেন্দ্রনাথ এক গায়ক সুনা-উল্লার কাছ থেকে ১২টি গান সংগ্রহ করেন। এই গানগুলোর একটি ছিল গগন ডাকহরকরার লেখা “আমি কোথায় পাবো তারে”।’

গগনের প্রতি মুগ্ধতা

এই গান শুনে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, গগন হরকরার এই কথাগুলোই যেন উপনিষদে বলা আছে, ‘তং বেদ্যং পরুষং বেদ মা বো মৃত্যু পরিব্যথাঃ।’ অর্থ: যাকে জানবার সেই পুরুষকেই জানো, নইলে যে মরণ-বেদনা।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘অ্যান ইন্ডিয়ান ফোক রিলিজিয়ন’-এ (ইংরেজি প্রবন্ধ) লিখেছিলেন, ‘প্রথম যে বাউল গানটি (আমি কোথায় পাব তারে) আমি মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলাম, সেটাই আমার মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছিল। এর কথা এতটাই সহজ যে তা অন্য ভাষায় অনুবাদ করতে গেলে আমার দ্বিধা হয়। তা ছাড়া গানের সুর না থাকলে তার সবচেয়ে সুন্দর দিকটাই হারিয়ে যায়—তার গতি ও রঙ মুছে যায়, যেন ডানাহীন প্রজাপতি।’

রবীন্দ্রনাথের এই গানের প্রেক্ষাপট

বাংলা ভাগের প্রস্তাব প্রথম আসে ১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। এর পর থেকেই শুরু হয় নানা রকম প্রতিক্রিয়া। এরপর ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর যখন বাংলা ভাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ শুরু হয়। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুরুতে এই আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু পরে তিনিও এর অংশ হয়ে ওঠেন।

রবীন্দ্রনাথ চাইতেন একটি অখণ্ড বাংলা। তাঁর আগ্রহ ছিল বাংলা ও বাঙালিত্ব নিয়ে, তাই তিনি বাংলাকে এক রাখার পক্ষে ছিলেন। রাজনীতির নানা মত ও টানাপড়েনের মধ্যেও তিনি বাংলাকে এক রাখার জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উদ্যোগ নেন। তাই আন্দোলনের প্রয়োজনে তৈরি হয়েছিল নতুন স্বদেশী গান ‘আমার সোনার বাংলা’।

বাংলার এক লোকশিল্পীর গানের সুরকে নিয়ে কবি যে অনন্যভাবে তাঁর স্বদেশপ্রেমের গান গড়লেন—তা আর কেউ বোধহয় এভাবে পারতেন না। রবীন্দ্রনাথের ছায়াসঙ্গী ও ছাত্র শান্তিদেব ঘোষের লেখায় পাওয়া যায়, ইচ্ছাকৃতভাবেই গগনের গানের সুর ব্যবহার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

গানটি যেভাবে আমাদের জাতীয় সংগীত হলো

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তবে তার আগেই গানটি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার অজিত রায় গানটির যন্ত্রসঙ্গীতও তৈরি করেন। এরও আগে ১৯৭০ সালে জহির রায়হানের চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’তে গানটি চমৎকারভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল।

স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সেই সময়ের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির স্বরলিপি সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই দায়িত্ব দেওয়া হয় শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র এবং রবীন্দ্রস্নেহধন্য শিল্পী আবদুল আহাদকে।

স্বরলিপিটি সংগ্রহ করতে শান্তিনিকেতনে গেলে বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ডেকে জানিয়েছিলেন, ‘আমরা যেভাবে গানটি গাই, সেটা বইয়ে ছাপা স্বরলিপির সুরের সঙ্গে মেলে না।’ অর্থাৎ আমাদের গাওয়া সুর ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর স্বরবিতান অনুযায়ী ছিল না। যেটা ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এইচএমভি রেকর্ড প্রকাশ করে। গানটি গেয়েছিলেন সুচিত্রা মিত্র। এরপর বিশ্বভারতী সিদ্ধান্ত নেয়, গানটির সঠিক স্বরলিপি তৈরি করে তারা বাংলাদেশে পাঠাবে। পরে বিশ্বভারতী স্বরলিপিটি বাংলাদেশে পাঠায়।

সব শেষে

এই গান আমাদের আত্মপরিচয়, আমাদের ইতিহাস, আমাদের অস্তিত্বের সুর। কুষ্টিয়ার এক নিভৃতপ্রায় বাউল সুরকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে ধারণ করে গড়ে তুলেছিলেন স্বদেশের গান, তা আজ আমাদের জাতীয় সংগীত। বাঙালির আবেগ, ভালোবাসা আর সংস্কৃতির প্রকাশ ‘আমার সোনার বাংলা’।

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হলেও, এই গানের আবেদন কেবল রাজনৈতিক প্রতিবাদে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং এতে মিশে আছে বাংলার প্রকৃতি, মানুষ, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা। আর সেই ভালোবাসার সুর রূপ নেয় একটি জাতির আত্মঘোষণায়। যা লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত একটি জাতি বেছে নিয়েছিল জাতীয় সংগীত হিসেবে।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment