এমআরটি লাইন-৬: মেট্রোরেলের নির্মাণ থেকে সরকার কি সরে যাচ্ছে
সজিব ঘোষ
রাজধানীর মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেলের বর্ধিত অংশের নির্মাণকাজ চলতি বছরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন আর সেটি হচ্ছে না। নির্মাণকাজ কবে শেষ হবে, তা নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। কেননা, এখনো কাজই শুরু হয়নি। এমনকি বর্ধিত অংশের নির্মাণকাজ থেকে অন্তর্বর্তী সরকার সরে আসছে, এমন পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে। তবে আপাতত প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে রাখতে চাচ্ছে মেট্রো নির্মাণকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
মূলত সমস্যার শুরু বর্তমান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন চুক্তি করা নিয়ে। পুরনো দরে নতুন চুক্তি করতে ঠিকাদার রাজি হচ্ছে না। কাজ করতে বরাদ্দের দ্বিগুণ টাকা দরপত্রে চাওয়া হয়েছে। এতে রাজি হচ্ছে না সরকার। ফলে চুক্তিও হচ্ছে না, কাজও এগোচ্ছে না।
মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ দুই ভাগে চলছে। একটি, অবকাঠামোভিত্তিক, অন্যটি, কারিগরি। অবকাঠামোর কাজে তেমন ব্যতয় না হলেও আটকে আছে কারিগরি কাজ। যেমন বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা, লিফট, চলন্ত সিঁড়ি, ট্রেনের দরজার সঙ্গে মিলিয়ে দরজা খোলার গেট, মনিটর, সিসিটিভি, সিগন্যাল ও টেলিকমিউনিকেশন যোগাযোগ স্থাপনের কাজ। প্রকৌশলের ভাষায় পুরো বিষয়টিকে এক শব্দে ‘ইলেকট্রোমেকানিক্যাল’ বলা হয়। শুধু এই ইলেকট্রোমেকানিক্যাল খাতের কাজ নিয়েই জটিলতা তৈরি হয়েছে।
গেল ২২ এপ্রিল ডিএমটিসিএলের বোর্ড সভায় বিষয়টি আলোচনায় উঠেছে। সভার নেতৃত্ব দেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক। সভায় অন্য ঠিকাদারদের কাছ থেকে দরপত্র নিয়ে দরের তুলনামূলক যাচাই করতে বলা হয় পরবর্তী বোর্ড সভার এজেন্ডায় বিষয়টি রাখা হয়েছে। সাধারণত প্রতি তিন মাস পর পর ডিএমটিসিএলের বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়। এখনো জরুরি বোর্ড সভা আহ্বানের কোনো লক্ষণ নেই। আর সিদ্ধান্ত না নিতে পারার প্রভাব পড়ছে মেট্রোর নির্মাণকাজে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র ঢাকা স্ট্রিমকে বলছে, আপাতত এসবে অন্তর্বর্তী সরকার মনোযোগ দিতে চাচ্ছে না। খরচ বাড়ানোর চাপ সরকার নিতে রাজি নয়। আবার জাইকার সঙ্গে চুক্তিও ভাঙতে চায় না। সব মিলিয়ে নীরব থেকে নিরাপদে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মেট্রো বর্ধিত অংশের কাজ থেকে সরকার সরে যেতে পারে।
যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তিনি ঢাকা স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমরা কাজে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে চাচ্ছি। জাইকার সঙ্গে চুক্তি নিয়ে আপত্তি নেই। কিন্তু দামটা তো জাস্টিফাই হতে হবে। আগে সেটা পরীক্ষা করার সক্ষমতা আমাদের ছিল না, এখন আছে।‘
এক প্রশ্নের জবাবে ফাওজুল কবির বলেন, ‘কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে কিনা, সেটা এখন কীভাবে বলব। এই বিষয় দেখতে শেখ মঈনুদ্দিনকে (প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সরহকারী) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি এগুলো ভালো বোঝেন।’
দরপত্রে বরাদ্দের দ্বিগুণ প্রস্তাব
২০২০-২১ অর্থ বছরের সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (আরডিপিপি) ইলেকট্রোমেকানিক্যালে খাতে ২৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কিন্তু দরপত্রে ঠিকাদার চাচ্ছে প্রায় ৫৪০ কোটি টাকা। এতে করে খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। আর ঠিকাদার দরপত্রে আরডিপিপির অতিরিক্ত টাকা চাওয়ায় এটি অনুমোদন করতে পারছে না ডিএমটিসিএল।
ডিএমটিসিএল সূত্র ঢাকা স্ট্রিমকে বলছে, বর্ধিত অংশের জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানের সুযোগ ছিল না। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশে যে প্রতিষ্ঠান যেসব কাজ করেছে, তাদের সঙ্গেই বর্ধিত অংশের জন্য নতুন করে চুক্তি করা হয়েছে। কিন্তু বরাদ্দের দ্বিগুণ খরচ চাওয়ায় উচ্চপদস্থদের অনুমতি ছাড়া এটি অনুমোদন করা যায়নি। এতে কাজ আটকে গেছে।
নতুন ঠিকাদার নিতেও জটিলতা
মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্পের অর্থায়ন করছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। অর্থায়নের চুক্তি অনুযায়ী, ঠিকাদার নির্ধারণে জাইকা ভূমিকা রাখবে এবং জাপানের বাইরে অন্য কোনো দেশ থেকে ঠিকাদার নিয়োগ করা যাবে না। সাধারণত, অন্যান্য দেশের সঙ্গে ঋণ চুক্তির আওতায় প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও এমন শর্ত উল্লেখ থাকে।
এই পরিস্থিতিতে চুক্তি ঠিক রেখে জাপানের বাইরে ঠিকাদার নিয়োগের সুযোগ নেই। নতুন ঠিকাদার থেকে দর পেতে জাইকার মাধ্যমে জাপানে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করতে হবে। পুরো প্রক্রিয়াটি সময় সাপেক্ষ। তা ছাড়া নতুন দরপত্র কাজের জন্য খরচ কম প্রস্তাব করা হবে কিনা—সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. জাকারিয়া ঢাকা স্ট্রিমকে বলেন, ‘জাইকার সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী জাপানের বাইরের ঠিকাদার নেওয়ার সুযোগ নেই। কাজ দেরি হলে সরকার রাজস্ব হারাবে। আমাদের হিসাবে বছরে অন্তত ১২৬ কোটি টাকা হারাতে হবে। এখন দিনে যাত্রীপ্রতি গড়ে ৪৬ টাকা পাওয়া যায়। কমলাপুর পৌঁছানো মানেই যাত্রীদের কাছ থেকে এই পরিমাণ ভাড়া বাবদ টাকা পাওয়া। আপাতত ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।’
ডিএমটিসিএল রাজি, সরকার নয়
গেল আওয়ামী লীগ সরকারের সময় টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য নির্ধারণ করা ছিল। কিন্তু বাজার উন্মুক্ত করার ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে। মেট্রোরেলের সরঞ্জাম কিনতে হবে ডলারে। মান কমে যাওয়ায় আগের থেকে টাকা এখন বেশি লাগবে। আবার অল্পসংখ্যক পণ্য দিতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ কম। পণ্যের পরিমাণ কম হওয়ায় পরিবহনের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে পণ্যের বাজার দর বেড়েছে। মোটাদাগে এসব কারণে দরপত্রে বেশি খরচ চেয়েছে ঠিকাদার।
ঠিকাদারের প্রস্তাবে ডিএমটিসিএলের সম্মতি ছিল। তাই বোর্ড সভার সপ্তাহ দুয়েক আগে ডিএমটিসিএলের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে বৈঠক করেছে। দরপত্র মেনে নেওয়ার বিষয়টি উপদেষ্টাকে বোঝানো হয়েছে বলে বৈঠক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বৈঠক সূত্র বলছে, বর্তমান ঠিকাদারের বাইরে গিয়ে অন্য কোনো ঠিকাদের সঙ্গে কাজ করতে গেলে নির্মাণের সময় আরও বেড়ে যাবে—বৈঠকে এমন আশঙ্কার কথাও তুলে ধরা হয়। একইসঙ্গে বাণিজ্যিক ক্ষতি, রাজস্ব হারানোর বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়। উপদেষ্টা তখন মন্তব্য করেননি।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে ওই বৈঠকে এবং বোর্ড সভায় অংশ নেওয়া এক কর্মকর্তা ঢাকা স্ট্রিমকে বলেন, ‘প্রথম আলোচনায় মনে হয়েছিল, উপদেষ্টার দরপত্রের বিষয়ে আপত্তি নেই। তাই আমরা দরপত্র অনুমোদনের প্রস্তুতি নিয়ে বোর্ড সভা শুরু হয়। কিন্তু সিনিয়র সচিব এ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা করতে চাননি। পরবর্তী সভার এজেন্ডায় পাঠিয়ে দেন। এই ঘটনায় সরকারের অনাগ্রহ স্পষ্ট।‘
কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৫১ শতাংশ
মতিঝিল-কমলাপুর ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বর্ধিত অংশের অবকাঠামোর কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। খুঁটি দৃশ্যমান। কমলাপুর মেট্রোস্টেশন নির্মাণের কাজও অনেক এগিয়ে গেছে। স্টেশনের দ্বিতীয় তলায় নির্মাণ কাজ চলছে। তবে পিলারের ওপরে ভায়াডাক্ট বসানোর কাজ এখনো শুরু হয়নি। সব মিলে এই প্রকল্পের নির্মাণকাজের অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৫০ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
গত এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৭৭টি খুঁটির সব কাজ শেষ। ৬১টি পাইলক্যাপের মধ্যে বাকি ২টি, পিয়ার বাকি ২টি, স্টেশনের সব কলাম নির্মাণ হয়েছে। উত্তরা কন্সট্রাকশন ইয়ার্ডে প্রিকাস্ট সেগমেন্টের কাজ শেষ। ২৭টির মধ্যে এখনও ২২টি স্প্যান বসানো বাকি। ১৮০ মিটার ট্র্যাক স্ল্যাবের মধ্যে ৯০ মিটার ট্র্যাক স্ল্যাব ঢালাই শেষ হয়েছে।
১.১৬ কিমিতে ব্যয় ১১ হাজার কোটি
উত্তর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো রেলপথের দৈর্ঘ্য ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার। এর সঙ্গে কমলাপুর পর্যন্ত যুক্ত হচ্ছে ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার। বর্তমানে ১৬টি স্টেশন থাকলেও বেড়ে হবে ১৭টি।
বাড়তি অংশের কাজ বাস্তবায়নসহ নানা খাতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা। যদিও উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। কমলাপুর যুক্ত করায় নতুন করে যে টাকা বেড়েছে, তার মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে যাবে আট হাজার ৪০৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা এবং জাইকার ঋণ থেকে ব্যয় হবে ৩ হাজার ৮১ কোটি ১১ লাখ টাকা।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না করা এবং মেয়াদ বাড়ানোর সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। না হলে প্রকল্পের যে সুফল পাওয়ার কথা ছিল, সেটি মানুষ পাবে না। এতে প্রকল্পের উপযোগিতা কমে যাবে।
ভাগেভাগে উদ্বোধন
মেট্রোর উত্তরা-আগারগাঁও অংশ ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়। পরদিন থেকে দেশের প্রথম মেট্রো ট্রেনে শুরু হয় যাত্রী পরিবহন। দ্বিতীয় ধাপে ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর মতিঝিলে আসে মেট্রো। এখন দিনে গড়ে চার লাখ যাত্রী মেট্রোতে যাতায়াত করেছে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment