গেজেট না হওয়া অধ্যাদেশ উল্লেখ করে চিঠি, আ.লীগের অনলাইন কার্যক্রম বন্ধ নিয়ে শঙ্কা
মো. ইসতিয়াক
ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, এর সহযোগী, অঙ্গ সংগঠনের সব ধরনের অনলাইন কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে (বিটিআরসি) চিঠি দিয়েছে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি। এই চিঠিতে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর ৮ নম্বর ধারা অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অধ্যাদেশটি এখনো গেজেট আকারে প্রকাশ হয়নি বলে এই নির্দেশের বৈধতা নিয়ে শুরু হয়েছে আইনি বিতর্ক।
এই অধ্যাদেশ এখনো গেজেট আকারে প্রকাশ না হওয়ায় আইনটি কার্যকর হয়নি। শুধু উপদেষ্টা পরিষদে খসড়া অনুমোদিত হয়েছে এবং আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি অধ্যাদেশ কার্যকর না হলে সেটির কোনো ধারা ব্যবহার করে সরকারি দপ্তর থেকে চিঠি বা নির্দেশনা জারি করা আইনগতভাবে বৈধ নয়।
অধ্যাদেশ না হলে ধারা প্রয়োগ নয়
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান, ‘কোনো অধ্যাদেশ যতক্ষণ না গেজেট আকারে প্রকাশিত হয় এবং আইন হিসেবে কার্যকর হয়, ততক্ষণ তার কোনো ধারা বা বিধান কার্যকর ধরা যায় না। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো চিঠি বা নির্দেশনা সেই অধ্যাদেশের ভিত্তিতে জারি করাও বিধিবদ্ধ নয়।’
জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার মতে, প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় ‘চলতি পথে’ কোনো অধ্যাদেশ কার্যকর নয় বলেই ধরা হয়। এটি আইনগতভাবে একটি খসড়ামাত্র, যতক্ষণ না তা প্রজ্ঞাপন আকারে জনগণের সামনে আসে।
একই ধারা থাকলে কি চিঠি বৈধ
সংশ্লিষ্ট দপ্তরের একজন কর্মকর্তা দাবি করেন, ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর ৮ নম্বর ধারা মূলত পূর্ববর্তী আইনেই বিদ্যমান ছিল। নতুন খসড়ায় শুধু একটি অতিরিক্ত লাইন যুক্ত হয়েছে, ‘স্বচ্ছতার স্বার্থে সরকার সকল ব্লক হওয়া কনটেন্টের তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।’ তাই তাঁর মতে, এই চিঠি জারিতে আইনগত সমস্যা নেই।
তবে এই যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সিনিয়র আইনজীবি ফারজানা ইসলাম। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘একটি নতুন অধ্যাদেশে পূর্ববর্তী আইনের ধারা হুবহু থাকলেও সেটি আলাদা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে, তাই তাকে পৃথক আইন বলেই গণ্য করতে হবে। খসড়া অবস্থায় থাকা কোনো অধ্যাদেশের ধারা বলে সরকারি সংস্থা চিঠি দিতে পারে না। এতে আইনের শাসন এবং নীতিগত স্বচ্ছতার প্রশ্নে গুরুতর সংকট তৈরি হয়।’
৮ নম্বর ধারায় যা আছে
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর ৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশ্বাস করে যে ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রচারিত কোনো তথ্য জাতীয় নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, জনশৃঙ্খলা বা ধর্মীয় সম্প্রীতিতে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে এবং তা সহিংসতা বা অপরাধে উদ্বুদ্ধ করছে, তাহলে তারা মহাপরিচালকের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে, অথবা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে।’
এই ধারা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার নামে কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়। তবে সেটি প্রয়োগ করতে হলে সংশ্লিষ্ট আইন বা অধ্যাদেশের কার্যকারিতা অপরিহার্য।
প্রযুক্তিগত বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতা
চিঠি পাওয়ার পর বিটিআরসি মেটা, গুগল, এক্স (টুইটার), টিকটকসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে ‘রিপোর্ট’ করেছে। তবে এই ধরনের চিঠি মানা হবে কিনা, তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব নীতিমালার ওপর।
একজন প্রযুক্তি বিশ্লেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম সাধারণত সরকার থেকে আসা অনুরোধ তখনই বিবেচনায় নেয়, যখন সুনির্দিষ্ট আইনি ভিত্তি এবং উপযুক্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। অকার্যকর অধ্যাদেশ উল্লেখ করে করা চিঠিকে তারা গুরুত্ব না-ও দিতে পারে।’
তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল ও অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সচল রয়েছে। এটি প্রমাণ করে, সরকারের ‘সম্পূর্ণ অনলাইন কার্যক্রম বন্ধ’ করার সক্ষমতা সীমিত। সরকারের পক্ষে মূলত ওয়েবসাইট ব্লক করা সম্ভব হলেও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কনটেন্ট সরানোর চূড়ান্ত ক্ষমতা থাকে বিদেশি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে।
অতীতের নজির
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে, বিটিআরসির অনুরোধে মেটা বাংলাদেশ থেকে ২,৯৪০টি কনটেন্ট সরিয়েছে। একই সময়ে গুগল পেয়েছে ৪৯০টি অনুরোধ, যার আওতায় ছিল ৫,৮২৭টি কনটেন্ট। অর্থাৎ, আইনি ও কূটনৈতিক ভিত্তি মজবুত হলে বিদেশি প্ল্যাটফর্মগুলো সরকারকে সহযোগিতা করে। কিন্তু তা হওয়ার জন্য প্রয়োজন সঠিক আইন ও প্রক্রিয়া।
এই ঘটনায় স্পষ্টভাবে প্রশ্ন উঠে আসে রাষ্ট্রীয়, ক্ষমতার প্রয়োগ এবং আইনি প্রক্রিয়ার যথাযথতা নিয়ে। অধ্যাদেশ এখনো গেজেট আকারে প্রকাশ না হওয়ায় এটি কার্যকর নয়—এই অবস্থায় তার কোনো ধারা উদ্ধৃত করে সরকারি নির্দেশনা পাঠানো সংবিধান ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাহিদুল ইসলাম স্ট্রিমকে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা বা প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণে কোনো অধ্যাদেশকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হলে সেটির কার্যকর অবস্থান থাকা আবশ্যক। গেজেট প্রকাশ ছাড়া কোনো অধ্যাদেশ আইনের মর্যাদা পায় না। এই রকম পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক সংস্থাগুলোর আরও সতর্কতা ও আইনি পরামর্শ নিয়ে এগোনো উচিত।’
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment