৪৯ বছর আগে ভাসানীর ফারাক্কা লং মার্চে যা ঘটেছিল
১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ অভিমুখে লং মার্চ করেন মওলানা ভাসানী। তখন তাঁর বয়স ৯০ বছরের বেশি। এই লং মার্চ ছিল আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার এক ঐতিহাসিক ঘোষণা। কী হয়েছিল সেদিন? বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে জানাচ্ছেন হাসান জামিল
১৯৭৬ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যখন ফারাক্কামুখী লং মার্চের ডাক দেন, তখন তাঁর বয়স ৯০ বছরের বেশি। সে সময় মওলানা ভাসানী বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। লং মার্চের আগের মাস অর্থাৎ এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখে তিনি হাসপাতাল থেকে ফেরার পর ঘোষণা দেন, ভারত যদি বাংলাদেশকে পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তাহলে তিনি লং মার্চ করবেন। ভাসানীর কর্মসূচী তখন সবাইকে চমকে দিয়েছিল। ৯০ বছরের একজন অসুস্থ মানুষের ঘরেই থাকার কথা। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে ১৬ মে রাজশাহী শহর থেকে লং মার্চ করার ঘোষণা দেন তিনি।
যেভাবে লং মার্চ
২ মে ১৯৭৬ মওলানা ভাসানীকে প্রধান করে ৩১ সদস্যবিশিষ্ট ‘ফারাক্কা মিছিল পরিচালনা জাতীয় কমিটি’ গঠিন করা হয়। এরপরে সদস্যসংখ্যা আরও বাড়ানো হয়। লং মার্চের আগে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটি চিঠি লিখেন ভাসানী। সে চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে লং মার্চের কারণ বর্ণনা করেন তিনি।
১৬ মে দুপুরে রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দান থেকে শুরু হয় ৬৪ কিলোমিটারের এই লং মার্চ। যা শেষ হয় পরদিন বিকেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে। ভারত সীমান্তের খুব কাছে কানসাট হাইস্কুল ময়দানে লং মার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। জীবনের শেষ বড় সমাবেশে মওলানা ভাসানী বলেন, ‘আমি আর এই বয়সে তোমাদের জন্য কী করতে পারি? আমার ফরিয়াদ আল্লার দরবারে যেন পৌঁছায়, যেন তাঁর রহমত হয় …’
সমাবেশের পরও ভাসানী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘অফিসার পর্যায়ে এই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ফারাক্কা ও সীমান্ত সমস্যার সমাধানে আপনি বাংলাদেশে আসুন এবং এর সমাধান খুঁজে বের করুন। অভিন্ন ঐতিহ্যের অধিকারী দু’দেশের মানুষের স্বার্থে সেটা খুব জরুরি।’
লং মার্চের প্রভাব
ভাসানীর এই লং মার্চের প্রভাব ছিল গভীর। লং মার্চের পরের বছরই ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে ফারাক্কা-সংক্রান্ত একটি পাঁচসালা চুক্তি করে। ওই চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ উপযুক্ত পরিমাণ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েছিল। বছরের সব থেকে কম প্রবাহের সময়কাল এপ্রিলের শেষ ১০ দিন ফারাক্কার প্রায় ৫৫ হাজার কিউসেক পানির মধ্যে বাংলাদেশ পাবে ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি। আর ভারত পাবে ২০ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি। কোনো কারণে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির পরিমাণ কমে এলে বাংলাদেশ তার প্রাপ্য অংশের ৮০ ভাগ, অর্থাৎ ২৭ হাজার ৬০০ কিউসেক পানি পাবে। এটি ছিল চুক্তির গ্যারান্টি ক্লজ। কিন্তু ১৯৮২ সালে ৫ বছর মেয়াদি চুক্তি শেষ হলে বাংলাদেশ সেটি নবায়ন করতে চাইলেও ভারতের আপত্তির কারণে সম্ভব হয়নি। এর পর থেকে বাংলাদেশ পায়নি পানির ন্যায্য হিস্যা। যদিও কয়েক দফা হয়েছে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।
১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের গঙ্গার পানি বণ্টন-সংক্রান্ত একটি সামগ্রিক চুক্তি সাক্ষর হয়। চুক্তিটি ছিল বাংলাদেশকে ন্যূনতম পানিসরাবরাহের গ্যারান্টিসহ ৩০ বছরের পানিবণ্টন চুক্তি। যা আগামী বছর শেষ হবে।
ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত থেকে কমবেশি ১০ কিলোমিটার দূরে। এই বাঁধের প্রভাব যতই দিন যাচ্ছে, ততই প্রকট হচ্ছে। আতঙ্কিত করছে পরিবেশকর্মীদের। প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে বাংলাদেশের গঙ্গা ও পদ্মা নদীতে চরের বিস্তার একটি নিয়মিত ঘটনা। পাশাপাশি গঙ্গা-পদ্মার শাখা-প্রশাখাসহ শতাধিক নদ-নদী ক্রমেই মৃত খালে রূপ নিচ্ছে। গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পে পানির ঘাটতির ফলে ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে। উজান থেকে স্বাদু পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে, ফলে মাটির উর্বরতা কমে এসেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রায় শতভাগ অগভীর নলকূপ এবং অনেক এলাকার অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে তীব্র পানির সংকট। সঙ্গে যোগ হয়েছে আর্সেনিক সমস্যা।
মওলানার দেখার চোখ
বাংলার মানুষ যে পানি পাবে না, ফারাক্কার ভাটির অংশ ধীরে মরুতে পরিণত হবে—এটি মওলানা ভাসানীই সবার আগে বুঝেছিলেন। তাই লেখক আহমদ ছফা বলেছেন,’বাংলাদেশের সর্বনাশ ঘটছে এটা তার চেয়ে স্পষ্ট করে কেউই বোঝে নাই।‘ মওলানা ভাসানীর অনুসারীদের একটা অংশ তাঁকে পীর হিসেবে মানতেন, কেউ কেউ তাঁকে একজন রাজনীতিবিদের চেয়ে দার্শনিক হিসেবেই বেশি বিবেচনা করতেন। তাঁর সমর্থকরা মনে করেন, ৪৫ বছর আগে ফারাক্কা বাঁধ সম্পর্কে মওলানা ভাসানী যা অনুমান করেছিলেন, এখন সেটিই ঘটেছে।
মৃত্যুর ঠিক পাঁচ মাস আগে তিনি দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যাকে দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন। তাঁর অসুস্থতার সেই সময়য়ের বর্ণনায় আহমদ ছফা বলছেন, ‘তখন তিনি অসুস্থ, দাঁড়াতে পারছেন না। পেশাবের বেগ তিনি ধরে রাখতে পারছিলেন না। বেদনায় সমস্ত মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে। ফলে জীবনের শেষ সেকেন্ডগুলো তিনি হিসাব করে খরচ করছিলেন।‘ সেই প্রতিটি সেকেন্ড হিসাব করা সময়টি তিনি ব্যয় করেন মানুষ, প্রাণ, প্রকৃতির প্রকৃত হিস্যা আদায়ের সংগ্রামে।
১৯৭৬ সালে আজকের মতো পরিবেশ বিপর্যয় বৈশ্বিক প্রপঞ্চ ছিল না। মানুষের পরিবেশ বিপর্যয়-সংক্রান্ত ধারণা ছিল খুবই কম। সেই সময়ে ভাসানী ভবিষ্যৎ দেখার মতো করে আজকের পৃথিবী, এখনকার বাংলাদেশকে দেখেছিলেন। একজন রাজনীতিবিদের সব চেয়ে বড় গুণ সম্ভবত দূরে দেখতে পারার চোখ। ভাসানী তাঁর দিব্য চোখ দিয়ে আমাদের তা দেখিয়েছিলেন,কেন নদী-প্রাণ-প্রকৃতিও আমাদের ‘পালন’ করতে হবে। ফারাক্কার লং মার্চ শুধু একটি লং মার্চই নয়, ভবিষ্যৎ পৃথিবী রক্ষার ইশারাও। আমরা কি আজও সেই ইশারা অনুভব করি?
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment