ফারাক্কা থেকে সিন্ধু: ভারতের ‘পানি-কূটনীতির’ শেষ কোথায়
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে পানি এখন কূটনৈতিক টানাপড়েনের কেন্দ্রবিন্দু। ভাসানীর ফারাক্কা লং মার্চের প্রায় ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও পানির ন্যায্য হিস্যা আজও প্রশ্নবিদ্ধ। ভারতের সিন্ধু চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্তের প্রভাব কি কেবল পাকিস্তানের ওপর পড়বে, নাকি বাংলাদেশও শঙ্কার ভেতর রয়েছে? লিখেছেন রাতুল আল আহমেদ
‘রেড মাওলানা’ খ্যাত আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল ফারাক্কা অভিমুখে লং মার্চ। নব্বই বছর বয়সে এসে ন্যায্য পানির দাবিতে তিনি যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বড় পরিসরের জনআন্দোলন। সেই আন্দোলন ছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্রের একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে দেশের জনগণের প্রতিবাদী অবস্থান।
ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তান সিন্ধু নদ অববাহিকার পানি বণ্টন নিয়ে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। সম্পর্কের টানাপড়েন সত্ত্বেও দুই দেশ দীর্ঘদিন সেই চুক্তি মেনে চলেছে।
তবে এপ্রিল মাসে পেহেলগামে এক সশস্ত্র হামলার পর প্রমাণ ছাড়াই পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত চুক্তি থেকে একতরফাভাবে সরে আসে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চেনাব, ঝিলম ও সিন্ধু নদে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন, যদিও এই নদীগুলোর পানি চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত।
এরই অংশ হিসেবে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে রণবীর খাল ৬০ কিমি থেকে ১২০ কিমি পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে ভারত সরকার। ১৯০৫ সালে কাশ্মীরের মহারাজা প্রতাপ সিং-এর সময় খনন করা এই খাল সিন্ধু চুক্তির বহু আগের হলেও সম্প্রসারণের মাধ্যমে ভারতের পানি প্রত্যাহারের ক্ষমতা বহুগুণ বাড়বে।
রয়টার্সের তথ্যমতে, রণবীর খাল ছাড়াও ভারত এমন কিছু প্রকল্প হাতে নিচ্ছে যা সরাসরি পাকিস্তানে পানিপ্রবাহ কমিয়ে দিতে পারে। একটি সরকারি নথিতে দেখা গেছে, চেনাব, ঝিলম ও সিন্ধুর পানি তিনটি উত্তর ভারতীয় রাজ্যে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে ভারত।
এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান ঘোষণা দিয়েছে, তারা বিশ্বব্যাংক, স্থায়ী সালিশ আদালত এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী মোহাম্মদ আওরঙ্গজেব স্পষ্ট বলেছেন, ‘পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়।’ তাঁর মতে, সিন্ধু চুক্তি বহাল রাখা ছাড়া অন্য কোনো পরিস্থিতি পাকিস্তানের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।
এই পরিস্থিতি শুধু পাকিস্তানের জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্যও উদ্বেগজনক। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৬ সালে। প্রশ্ন উঠেছে, ভারত যদি সন্ত্রাসবাদের অজুহাত তুলে পাকিস্তানের পানি চুক্তি বাতিল করতে পারে, তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সঙ্গেও কি একই আচরণ করবে?
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন নদী থাকলেও কেবল গঙ্গার পানি বন্টনের জন্যই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাকি নদীগুলোর বিষয়ে আলোচনা বহুদিন ধরে চললেও কার্যকর কোনো সমাধান আসেনি। বিশেষ করে তিস্তা চুক্তি বারবার রাজনৈতিক বাধায় আটকে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আপত্তি ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অনীহার কারণে এই চুক্তি আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
এখন ভারত নিজেই যখন আন্তর্জাতিক চুক্তিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, তখন বাংলাদেশের মতো ছোট প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জন্য আশঙ্কা বাড়ছেই। গ্রীষ্মকালে গঙ্গা, তিস্তা বা অন্যান্য নদীর প্রবাহ হঠাৎ কমে গেলে বাংলাদেশে কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও পানীয় জলের ক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক কৌশলে পরিবর্তন আনা জরুরি। শুধু চুক্তি স্বাক্ষরের অপেক্ষায় না থেকে, আন্তর্জাতিক আইন ও সংস্থায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং আঞ্চলিক পানি নিরাপত্তা জোট গড়ে তোলার দিকে এগিয়ে যাওয়া এখন সময়ের দাবি।
মওলানা ভাসানীর সেই ফারাক্কা লংমার্চ ছিল একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে জাতীয় চেতনার প্রতীক। আজ যখন পানিকে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তখন তাঁর দেখানো পথেই কি মুক্তি মিলবে দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ মানুষদের?
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment