স্থলবন্দরে ভারতীয় নিষেধাজ্ঞা: কী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে
ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। গত শুক্রবার (১৭ মে) ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা জারি করেছে। এই নির্দেশনার ফলে বাংলাদেশের রপ্তানিজাত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কী প্রভাব পড়বে? জানাচ্ছেন মো. ইসতিয়াক
ডিজিএফটির নির্দেশনায় বলা হয়, এখন থেকে তৈরি পোশাকসহ নির্দিষ্ট কিছু পণ্য কেবল সমুদ্রবন্দর দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে— স্থলবন্দর ব্যবহার করা যাবে না। দেশের প্রাণ–আরএফএল, আকাশ লিমিটেড, ওয়ালটনের মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভারতে পণ্য রপ্তানি করা করতো। উত্তর–পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে এ সব প্রতিষ্ঠান চ্যাংড়াবান্ধা, ফুলবাড়ী, আঘরাতলা, শোনামুড়া, মহদীপুর, গীতালদহ প্রভৃতি স্থলবন্দর ব্যবহার করে।
কোম্পানিগুলোর দাবি, এখন তাঁদেরকে চেন্নাই বা কলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে হবে, যা সময় ও খরচ— উভয়ই বাড়বে। পরিবহন সহায়ক সামগ্রীর খরচ ও সময় ৩০–৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। বহুদিনের বানিজ্যিক রুট বন্ধ হওয়ায় গ্রাহক–বিক্রেতার সম্পর্ক দূর্বল হবে। ছোট উদ্যেক্তারা অর্থাত্ যাঁদের পণ্যের পরিমাণ কম, তাঁদের জন্য সমুদ্রপথে রপ্তানি অনিয়মিত ও অলাভজনক। ফলে রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে কোম্পানিগুলো।
নিষেধাজ্ঞার আওতায় কী আছে
ভারত সরকারের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, এখন থেকে তৈরি পোশাক, প্রসাধনী, খাদ্যপণ্য (যেমন জুস, চিপস, কনফেকশনারি), প্লাস্টিক সামগ্রী, আসবাবপত্র, ও পিভিসি সামগ্রী উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। শুধুমাত্র কলকাতা ও নবসেবা (নাভি মুম্বাই) সমুদ্রবন্দর দিয়ে সেসব পণ্য প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে মাছ, এলপিজি, পাথর, ভোজ্যতেল ইত্যাদি পণ্যের জন্য স্থলবন্দরের ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই।
অতীতের প্রেক্ষাপট
২০১৫ ও ২০১৮ সালেও ভারতের কিছু সীমান্ত এলাকায় অঘোষিত বাধা সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে বাংলাদেশের চামড়া ও পেঁয়াজ রপ্তানির সময়। ২০১৯ সালে ভারত হঠাৎ করে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, ফলে বাংলাদেশে ব্যাপক সংকট দেখা দেয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশে প্রতিবাদ ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ভারতের পিছু হটতে হয়। তখন থেকেই ভারত একাধিকবার ‘অঘোষিত নন–ট্যারিফ ব্যারিয়ার’ প্রয়োগ করে আসছে, যা বাণিজ্য ভারসাম্যে প্রভাব ফেলেছে।
ব্যবসায়ীরা যা বলছেন
প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল স্ট্রিমকে বলেন, ‘ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলে অনেক পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে স্থলবন্দর ব্যবহার না করতে পারলে লজিস্টিক খরচ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাবে। এতে ভারতের স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে পারবো না।’
বিজিএমইএ’র পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘ভারতীয় ক্রেতাদের সঙ্গে আমাদের একাধিক চুক্তি এখন অনিশ্চয়তায় পড়েছে। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে আমাদের জন্য এটি বড় ধাক্কা।’
নন–ট্যারিফ ব্যারিয়ারের কৌশল
অর্থনীতিবিদ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান ভারত সরকারের সাম্প্রতিক অশুল্ক নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, এ সব বিধিনিষেধ বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করবে এবং আঞ্চলিক বাণিজ্যের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
তিনি বলেন, ভারতের মূল ভূখণ্ড ও উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে স্থলবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশ যে সব ভোগ্যপণ্য রপ্তানি করত, সেগুলোর মধ্যে ফলের রস, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, প্লাস্টিকসামগ্রী ও তৈরি পোশাককে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে। এই ধরনের অশুল্ক প্রতিবন্ধকতা শুধু দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংযুক্তিকে ব্যাহত করবে।
ড. রায়হান আরও বলেন, বিশেষভাবে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে এখন শুধু কলকাতা ও নবসেবা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফলে রপ্তানিকারকদের অতিরিক্ত পরিবহন ব্যয় এবং সময়ের সংকটের মুখে পড়তে হবে। এতে দীর্ঘমেয়াদে সরবরাহ শৃঙ্খলা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং পারস্পরিকভাবে লাভজনক বাণিজ্যের পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হবে।
ভারতের অভ্যন্তরীণ চাপ এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে রয়েছে দেশটির লোকসভা নির্বাচন–পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা। উত্তর–পূর্বাঞ্চলের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছিলেন যে বাংলাদেশি সস্তা পণ্য বাজারে প্রভাব ফেলছে। ফলে মোদি সরকারের ওপর স্থানীয় চাপে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
ভারতের জনপ্রিয় অর্থনীতিবিদ ড. জয়তি ঘোষ সম্প্রতি দ্য হিন্দু বিজনেসলাইন -এ বলেন, ‘ভারতীয় বাজারে বিদেশি পণ্যের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে বিজেপি সরকার আগেও এমন পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে প্রতিবেশী দেশের ক্ষেত্রে এমন আচরণ আঞ্চলিক সহযোগিতাকে দুর্বল করে।’
বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান
বাংলাদেশ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে তারা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা চলছে এবং প্রয়োজন হলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) ও বে অব বেঙ্গল ইনশিয়েটিভ ফর মাল্টি–সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো–অপারেশন (বিমসটেক)-এর মাধ্যমে বিষয়টি তুলেও ধরা হতে পারে।
বাণিজ্য সচিব তোফায়েল হোসেন বলেন, ‘আমরা আশা করি ভারত বন্ধুপ্রতীম দেশ হিসেবে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে। আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্কের জায়গা থেকে এই সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনা সম্ভব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেরসর আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ভারতের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য শুধু বাণিজ্যিক নয়, কূটনৈতিক বার্তাও বয়ে এনেছে। দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখনো রাজনৈতিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ দোলাচলে কতটা প্রভাবিত হয়, তা ফের প্রমাণ হলো। বাংলাদেশের রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও বিকল্প বাজার তৈরি এখন সময়ের দাবি।’
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment