আমাদের ভাষা আন্দোলন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ভাষার লড়াই করেছিলেন যাঁরা
ভাষার অধিকারের জন্য রক্ত দিতে হয়েছিল কেবল ঢাকায় নয়, শিলচরেও। ১৯৬১ সালের (১৯ মে) আজকের দিনে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালিরা অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে রেললাইন অবরোধ করলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ১১ জন। এই আন্দোলন ছিল শুধু ভাষার জন্য নয়—ছিল জাতিগত বৈষম্য ও রাষ্ট্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক রক্তাক্ত প্রতিরোধ। সেই ঐতিহাসিক শিলচর ভাষা আন্দোলন নিয়ে জানাচ্ছেন শতাব্দীকা ঊর্মি
১৯৪৭ সালে দেশভাগ ছিল এক জটিল রাজনৈতিক সমঝোতা, যেখানে রাজ্য, ভাষা, জাতি, শ্রেণি—সব কিছুরই ভূমিকা ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে আসাম ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যেখানে দেশভাগের মধ্যেই জন্ম নেয় ‘বাঙালি-বিরোধী’ মনোভাব এবং এক নতুন জাতিগত রাজনীতির সূচনা হয়।
বাঙালিরা দাবি তোলেন যে বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। বাঙালিদের ওপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ নামক সংগঠনটির জন্ম হয়। আহ্বানে নেওয়া হয় শান্তিপূর্ণ এক রেল অবরোধ কর্মসূচি। আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ, সহিংসতা নয়।
শিলচর রেল স্টেশনে উপস্থিত আন্দোলনকারীদের ওপর আচমকা গুলি চালায় পুলিশ। মুহূর্তেই শহীদ হন ১১ জন। শহীদেরা হলেন কমলা ভট্টাচার্য, হিতেশ বিশ্বাস, চিত্ত রঞ্জন দেব, সত্যেন্দ্র দেব, সুনীল সরকার, সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ সেন, কানাইচরণ দাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর, শচীন্দ্র চন্দ ও দুলাল বিশ্বাস। ভাষা আন্দোলনের সেই রক্তাক্ত অধ্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আসামের কাছাড় জেলার মানুষ। কলকাতার মতো সাংস্কৃতিক রাজধানীর বাসিন্দা তাঁরা ছিলেন না, ছিলেন না ঢাকার মতো ‘রাজনৈতিক চেতনা’য় টগবগে। ছিল না জাতীয় স্তরের কোনো গৌরবের মঞ্চ। তবু নিখাদ মাতৃভাষার টানেই পথে নেমেছিলেন তাঁরা। হাজারো মানুষ গড়ে তুলেছিলেন এক গণ-অভ্যুত্থান।
এভাবেই আমরা পেয়েছিলাম বিশ্বের প্রথম নারী ভাষা শহিদ কমলা ভট্টাচার্যকে।
আন্দোলনের পটভূমি
আসাম ব্রিটিশ ভারতের অংশ হয়ে উঠলে উনবিংশ শতক থেকে সেখানের প্রশাসনিক ও শিক্ষা কাঠামোতে বাঙালিদের অন্তভুর্ক্ত করতে শুরু করে ব্রিটিশ শাসকেরা। এদিকে রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ১৮৮৪ সালে সিলেটকে বাংলা প্রদেশ থেকে আলাদা করে আসামে যুক্ত করা হয়। এই পরিস্থিতিতে আসামের স্থানীয় জনগণ ভয় পেতে শুরু করে যে এই বাঙালিরা তাদের রুটিরুজিতে ভাগ বসাবে। সেই ভয় থেকেই জন্ম নেয় জাতিগত চেতনা। আসাম কংগ্রেস, বিশেষ করে স্থানীয় নেতৃত্ব মনে করত, বাঙালির আগমন মানে অসমিয়া সংস্কৃতির অপমৃত্যু। এই ‘সাংস্কৃতিক প্রতিরক্ষা’ ধীরে ধীরে রূপ নেয় রাজনৈতিক কৌশলে।
আসাম কংগ্রেসের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈর ভূমিকা দেশভাগের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নিখিল ভারত কংগ্রেস চেয়েছিল অখণ্ড ভারত। তবে আসাম কংগ্রেস চাইছিল প্রয়োজনে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হোক, কিন্তু বাংলাকে বাদ দিয়ে।
ইতিহাসবিদদের মতে, বরদলৈ চেয়েছিলেন এক ‘খাঁটি’ অসমিয়া রাষ্ট্র, যেখানে বাঙালির প্রশাসনিক আধিপত্য থাকবে না। এই সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটে ১৯৪৭-এর সিলেট রেফারেন্ডাম বা গণভোটে। বহু অভিযোগ সত্ত্বেও সিলেটের অধিকাংশ অংশ পাকিস্তানে চলে যায়, শুধু করিমগঞ্জ বাদে। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে সিলেটে অনুষ্ঠিত হয় গণভোট।
যদিও এটি ছিল জনগণের মতামত জানার একটি পন্থা, কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এতে ছিল প্রচুর রাজনৈতিক কারসাজি ও বিভ্রান্তি। ধর্মের ভিত্তিতে ভোট হলেও সিলেটের জনগণ ছিল সংস্কৃতিতে বাঙালি। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, মুসলমান হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁদের আত্মিক কোনো সম্পর্ক ছিল না।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বাংলাভাষী বহু মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন আসামের বরাক উপত্যকায়। শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি—এই তিন জেলা ছিল বাংলাভাষীদের প্রধান কেন্দ্র। কিন্তু স্বাধীনতার পর আসাম সরকার এক আশঙ্কাজনক ভাষানীতির পথে হাঁটে। ১৯৬০ সালে আসাম সরকার ঘোষণা দেয়, আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা হবে শুধু অসমিয়া। এর ফলে বরাক উপত্যকার বাঙালিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ভয়, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ। বলে রাখা ভালো, এই বাঙালিরা ছিলেন ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলনে উজ্জীবিত হওয়া মানুষ।
অনেকে মনে করেন, ভারতের কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে আসামের ভূখণ্ড রক্ষা তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই তারা সিলেট ছাড়ার বিষয়টিকে বড় করে দেখেনি। দেশভাগের পর যে বাঙালিরা আসামে থেকে গিয়েছিলেন, তাঁরা হয়ে ওঠেন ‘অপর’ বা বহিরাগত। আসাম সরকারের নানা নীতিতে বাঙালিদের ভাষা, শিক্ষা ও ভূমির অধিকার খর্ব হতে থাকে।
এই বঞ্চনা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৬০-৬১ সালে, যখন অসম সরকার ঘোষণা করে, ‘আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা হবে অসমিয়া।’
এটি শুধু ভাষার জন্য লড়াই নয়, ছিল এক বহিরাগত-ভিত্তিক রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ—যার শিকড়ে ছিল দেশভাগ-পূর্ব ইতিহাস।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment