৫ আগস্টের পর সীমান্তে ২৫ হত্যা: বিএসএফ কেন এত গুলি চালাচ্ছে
সীমান্তে বাংলাদেশিদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ও মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ ১৯ মে বিএসএফের গুলিতে আহত হন বাংলাদেশি তরুণ শামসুল হক। ভারতের দাবি, কেবল অপরাধীদেরই গুলি করা হচ্ছে। আসলেই কি তাই? তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছেন কৌরিত্র পোদ্দার তীর্থ
১৯ মে সোমবার ভোরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে আহত হন শামসুল হক। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরে সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ শামসুলকে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তিনি শঙ্কামুক্ত।
সুনামগঞ্জ ব্যাটলিয়ন ২৮ বিজিবির অধিনায়ক একেএম জাকারিয়া কাদির বলেন, আহত যুবক অবৈধ চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে পণ্য আনার সময় গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
শামসুলের হকের গুলিবিদ্ধ হওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বিএসএফের হাতে ৩১ বাংলাদেশি নিহত হন। অর্থাৎ মাসপ্রতি প্রায় ২.৫৮ জন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ে এই হার কিছুটা কমে। এ সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর গুলি ও তাড়া খেয়ে ১৭ বাংলাদেশি মারা যান। অর্থাৎ মাসপ্রতি প্রায় ২.৪৩ জন।
কিন্তু ৫ আগস্ট বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সীমান্ত হত্যার হার বেড়ে যায়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানাচ্ছে, গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বিএসএফের হাতে ২৪ বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এ সময় মাসপ্রতি মৃত্যুর হার প্রায় ২.৬৭ জন। যা গত আড়াই বছরে সর্বোচ্চ। এ মাসের চার তারিখ, আরেক বাংলাদেশি, মো. সাকিব (১৮) বিএসএফের গুলিতে নিহত হন। সব মিলিয়ে ৫ আগস্টের পর সীমান্তে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫-এ।
এ ধরনের সীমান্ত হত্যাকে মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন বলে আখ্যায়িত করেছেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান।
আগস্টের পর মৃত্যুর খতিয়ান
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালান। এর ঠিক ছয়দিনের মাথায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ওয়াহেদপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে মারা যান আব্দুল্লাহ। মৃত্যুর তিন দিন পর তাঁর লাশ দেশে ফেরত আসে।
একই বছরের ১ সেপ্টেম্বর আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ১৩ বছর বয়সী স্বর্ণা দাস। ওই মাসের ৮ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁও সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে মারা যান আরেক কিশোর জয়ন্ত কুমার সিংহ (১৫)। তাঁর লাশ ৪৮ ঘণ্টা পর ফেরত দেয় ভারতীয় বাহিনী।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্টের পর বিএসএফ সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করেছে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে। ছয়জন বাংলাদেশিকে ওই মাসে মেরে ফেলা হয়। ২০২৪ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে দুইজন করে চারজন ও অক্টোবরে তিনজনকে হত্যা করা হয়। কেবল নভেম্বর মাসে বিএসএফের হাতে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।
এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত অন্তত ১১ বাংলাদেশি বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু এপ্রিলেই পাঁচজন মারা যান। তাছাড়া মার্চে তিনজন, ফেব্রুয়ারিতে একজন ও জানুয়ারিতে দুইজন মারা গেছেন।
বাংলাদেশের জবাব
‘বিজিবির মতো একটা ফোর্সকে পিঠ দেখাতে বলেছে সীমান্তে। সীমান্তে আমাদের লোক মারে, বিজিবি পতাকা বৈঠক করতে বাধ্য হয়। আমি বলেছি যে পিঠ দেখাবেন না। এনাফ ইজ এনাফ’, গত বছরের ১৩ আগস্ট এক বক্তব্যে বলেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।
এই বক্তব্যের পর থেকে সীমান্তে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশি হত্যায় আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা। স্বর্ণা দাসের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বিজিবি ও বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠক নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী মন্তব্য করেন, এবার সংলাপে বাংলাদেশের কথার ‘টোন’ আলাদা হবে।
বৈঠকে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী সীমান্ত হত্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সেইসাথে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে বিএসএফকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান।
যে ছয়টি বিষয়ে ওই বৈঠকে মতৈক্য হয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল সীমান্তহত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে একযোগে কাজ করা।
বাড়ছে পুশ-ইনের ঘটনা
সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ভারতের পক্ষ থেকে পুশ-ইনের ঘটনা ঘটেছে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় অন্তত তিন শতাধিক ব্যক্তিকে ঠেলে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে বহু বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছেন যারা পূর্বে অবৈধভাবে ভারতে গিয়েছেন। এছাড়া কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাও এখানে রয়েছেন। তবে ঠেলে পাঠানো সকলের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এ ধরনের কার্যক্রমকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। তাঁর মতে, যথাযথ প্রক্রিয়ায় এই ব্যক্তিদের পাঠানো হচ্ছে না।
ভারতের ভাষ্য
২০২২ সালে বিএসএফ মহাপরিচালক পঙ্কজ কুমার সিং দাবি করেন, তাঁর বাহিনীর গুলিতে যারা মারা গেছেন, তাঁরা সকলে অপরাধী। এরা সকলেই গবাদিপশু ও মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত। প্রতিটি গোলাগুলির ঘটনা রাতে ঘটেছে যখন বিএসএফ নিজে আক্রান্ত ছিল।
তিন বছর পরও ভারতীয় এ বয়ানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। স্বর্ণা দাসের মৃত্যু নিয়ে হিন্দুস্তান টাইমসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে বিএসএফের বরাতে বলা হয়, ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশের সময় স্বর্ণা দাসকে বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনীই গুলি করেছে।
ওই প্রতিবেদনে এক সিনিয়র বিএসএফ কর্মকর্তা বলেন, ‘৫ আগস্টের পর বহু বাংলাদেশি অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই বলপ্রয়োগ করা হয়নি। বরং প্রত্যেক অনুপ্রবেশকারীকে গ্রেপ্তার করে পতাকা বৈঠকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
একই ঘটনা নিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বিএসএফ দাবি করে, বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী স্বর্ণার লাশ গ্রহণ করতে চায়নি।
বিভিন্ন সময় বিএসএফের দেওয়া বক্তব্যে মূলত যে বয়ানটি উঠে এসেছে, তা হলো, বাংলাদেশিরা অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করে বিএসএফকে আক্রমণ করে। এই বাংলাদেশিরা মূলত অবৈধ চোরাচালানের কাজে জড়িত। আক্রান্ত হওয়া ছাড়া বিএসএফ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে না।
গত বছরের ৮ অক্টোবর কুমিল্লা সীমান্তে কামাল হোসেন মারা যান। এ ঘটনায় বিএসএফের ত্রিপুরা ফ্রন্টিয়ার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, একদল বাংলাদেশি দুর্বৃত্ত ধারালো অস্ত্র নিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ করে এক বিএসএফ সদস্যকে হামলা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএসএফ গুলি চালাতে বাধ্য হয়।
বিএসএফের পূর্ব কমান্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক রবি গান্ধী গণমাধ্যমে বলেন, ‘গোলাগুলির ঘটনা তখনই ঘটে যখন বড় একটি দল দালালের মাধ্যমে ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে এবং কখনো বিএসএফ সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। তখন আত্মরক্ষার্থে বিএসএফ গুলি চালায়।’
এ বছর ফেব্রুয়ারিতে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএসএফ মহাপরিচালক দলজিৎ সিং চৌধুরী বলেন, মানবাধিকারের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান রেখে সীমান্তহত্যা কমাতে বিএসএফ ‘অ-প্রাণঘাতী’ নীতি অনুসরণ করবে। কিন্তু সে মাসেও সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যার ঘটনা ঘটে।
আইন কী বলছে
বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত সম্পর্কিত বিষয়গুলো সুরাহা করতে ১৯৭৫ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়, যেখানে দুই দেশের স্বাক্ষর রয়েছে। ‘জয়েন্ট ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ গাইডলাইনস ফর বর্ডার অথোরিটিজ অব দ্য টু কান্ট্রিজ’ নামক এই নীতিমালার ৮(আই) ধারা অনুসারে, কোনো দেশের নাগরিক অবৈধভাবে অন্য দেশে প্রবেশ করলে সংশ্লিষ্ট সীমান্তরক্ষী বাহিনী যৌক্তিক ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার রাখেন। তবে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বাঞ্ছনীয় নয়।
গবাদিপশু পাচারের ক্ষেত্রে এই নীতিমালার ৮(এম) ধারায় বলা হয়, গবাদিপশু পাচারের ঘটনা ঘটলে অপর পক্ষের পোস্ট কমান্ডারকে তা বিস্তারিত জানাতে হবে। সেই পোস্ট কমান্ডার তখন নিজ দেশের নিকটস্থ থানায় বিষয়টি অবহিত করবেন। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কথা বলা নেই।
প্রসঙ্গ যখন মানবাধিকার
‘এখন পর্যন্ত আমাদের যে সমস্ত নাগরিকেরা হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন, তাঁরা কিন্তু সশস্ত্র ছিলেন না, কোনো যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে না, তারপরও আমাদের নাগরিকেরা হত্যাকান্ডের শিকার হন। এতে চূড়ান্তভাবেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে’, এক সাক্ষাৎকারে স্ট্রিমকে বলেন আইনজীবী নূর খান।
৫ আগস্টের পর সীমান্তহত্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘সময়ে সময়ে এটি বাড়ে এবং কমে, এই বাড়া এবং কমার সাথে পরিবেশ, পরিস্থিতি, রাজনৈতিক বিবেচনা এগুলোর সংশ্লিষ্টতা অনুমেয়। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পরে যে মৃত্যুর সংখ্যা আমরা দেখছি বর্ডারে, এটির পেছনে একটি বড় কারণ হচ্ছে, ভারতের বড় ভাইসুলভ মনোভাবটা আরও স্ট্রং হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির বিবেচনায় যদি আমরা হিসাব করি, এখান থেকে স্বৈরাচারের দোসররা কিন্তু ঐ দেশে আশ্রয় পাচ্ছে। ফলে আমাদের সম্পর্কে একধরনের অবনতি হয়েছে- এটা ধরে নেওয়া যায়।’
সমস্যা চিহ্নিতকরণে দুই দেশের ব্যর্থতা বা ভারতের একপেশে গোঁয়ার্তুমিকে সীমান্তহত্যা বন্ধ না হওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি।
‘যদি তাঁরা লুঙ্গি পরেন, তবে গুলি খাওয়ার আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়।’ সীমান্তহত্যা নিয়ে এক গণমাধ্যমে কথাটি বলেন কিরীটি রায়। তিনি কলকাতা-ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন, ‘বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের’ (মাসুম) সচিব। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ভারতের পাঞ্জাব-হরিয়ানা থেকে গরুগুলো সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছানো আটকানো হয় না কেন। তাঁর অভিযোগ, সীমান্তে গুলি তখনই চলে, যখন বিএসএফের সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারায় মেলে না।
কিরীটি রায়ের সংগঠন মাসুম ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মিলে ২০১৯ সালে একটি ৮১ পাতার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে অভিযোগ করা হয়, ২০০০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত বিএসএফ ৯০০-এর বেশি বাংলাদেশিকে হত্যা করে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশীয় পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘ভারত সরকার সীমান্তরক্ষীদের গুলি চালানো থেকে বিরত থাকার ও সংযম দেখানোর নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও নতুন করে হত্যা, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। নিরাপত্তারক্ষীদের জবাবদিহির আওতায় না আনার ফলে এ ধরনের নিপীড়ন বেড়েছে এবং এতে অত্যন্ত দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষরা বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন।’
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment