স্টারলিংক: যেভাবে এল বাংলাদেশে, সংযোগ নেবেন কীভাবে, খরচই বা কত
মারুফ ইসলাম
মার্কিন প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা ‘স্টারলিংক’ আজ সোমবার থেকে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব আজ মঙ্গলবার সকালে এক ফেসবুক পোস্টে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এরপর থেকে শুরু হয়েছে স্টারলিংক নিয়ে আলোচনা। বাংলাদেশ থেকে কীভাবে স্টারলিংকের সংযোগ পাওয়া যাবে, কত খরচ পড়বে, প্যাকেজগুলো কেমন, মাসিক কত টাকা ব্যয় হবে ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক কৌতুহল দেখা দিয়েছে মানুষের মধ্যে।
স্টারলিংকের সংযোগ নেবেন কীভাবে
স্টারলিংকের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (starlink.com) বলছে, বাংলাদেশের গ্রাহকরা সরাসরি স্টারলিংকের ওয়েবসাইটে গিয়ে সংযোগ নেওয়ার অর্ডার দিতে হবে। অর্ডার করতে প্রথমে আপনার ঠিকানা দিয়ে সেখানে এই সেবা পৌঁছাবে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। তারপর একটি সার্ভিস প্ল্যান বেছে নিয়ে ‘স্ট্যান্ডার্ড কিট’ কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
এই স্ট্যান্ডার্ড কিটের মধ্যে রয়েছে একটি স্যাটেলাইট ডিশ, ওয়াইফাই রাউটার, মাউন্টিং ট্রাইপড ও ক্যাবল। এরপর সংযোগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে স্যাটেলাইট ডিশটি ফাঁকা জায়গায় আকাশের দিকে মুখে করে স্থাপন করতে হবে।
স্টারলিংক প্যাকেজ
স্টারলিংকের ওয়েবসাইটে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ব্যবহারের জন্য তারা দুটি প্যাকেজ দিচ্ছে। প্রথমটি স্টারলিংক ‘রেসিডেনশিয়াল’। এর জন্য প্রতি মাসে খরচ করতে হবে ছয় হাজার টাকা। আর ‘রেসিডেনশিয়াল লাইটের’ জন্য মাসে খরচ হবে চার হাজার ২০০ টাকা।
এ ছাড়া কোথাও ঘুরতে গেলে বা চলন্ত অবস্থায় স্টারলিংক ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করতে ‘রোম’ প্যাকেজ ব্যবহার করা যাবে। এর জন্য প্রতি মাসে দিতে হবে নূন্যতম ছয় হাজার টাকা।
রোমের এই প্যাকেজে ৫০ জিবি পর্যন্ত ডেটা পাওয়া যাবে। আর আনলিমিটেড ডেটার জন্য নিতে হবে ১২ হাজার টাকার ‘রোম আনলিমিটেড’ প্যাকেজটি।
এ ছাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্যও বিভিন্ন প্যাকেজ রয়েছে স্টারলিংকের। এ জন্য ৪৭ হাজার টাকা দিয়ে এককালীন স্ট্যান্ডার্ড কিট কিনতে হবে।
স্টারলিংক সংযোগ নিয়ে ৩০ দিন ব্যবহার করার পর সেবা ‘সন্তোষজনক’ মনে না হলে সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দেওয়া হবে বলেও স্টারলিংকের ওয়েবসাইটে ঘোষণা রয়েছে।
স্টারলিংক ও সাধারণ ইন্টারনেটের পার্থক্য কী
বিশ্বের যেসব অঞ্চলে অপটিক্যাল ফাইবার পৌঁছানো দুঃসাধ্য, সেখানে খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারে স্যাটেলাইটের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। আর এর সাহায্যে দুর্গম এলাকাগুলোতেও সহজে পৌঁছানো যায় ইন্টারনেট সেবা। বাংলাদেশের দুর্গম এলাকায় খুব সহজে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যাবে এর মাধ্যমে। বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে স্টারলিংকের কার্যক্রম রয়েছে।
কী ভাবছে দেশের মানুষ
বাংলাদেশে এখন যে ইন্টারনেট সেবা দেওয়া হয়, তা সাবমেরিন কেবলনির্ভর। অর্থাৎ সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে তারের মাধ্যমে ব্যান্ডউইডথ এনে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডাররা (আইএসপি) মানুষকে ইন্টারনেট সেবা দেয়।
অন্যদিকে স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা দেয় স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে। স্টারলিংকের মূল প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাদের ইন্টারনেট-সেবা জিওস্টেশনারি (ভূস্থির উপগ্রহ) থেকে আসে, যা ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার ওপর থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে স্থাপিত হাজার হাজার স্যাটেলাইটের একটি সমষ্টি হচ্ছে স্টারলিংক, যা পুরো বিশ্বকেই উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা দিতে পারে।
২০২৫ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত হিসাবে, স্টারলিংকের ৬ হাজার ৯৯৪টি স্যাটেলাইট স্থাপিত হয়েছে। এসব স্যাটেলাইট পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৪২ মাইল (৫৫০ কিলোমিটার) ওপরে কক্ষপথে ঘুরছে।
সরকার যা বলছে
প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, স্টারলিংকে কোনো স্পিড ও ডেটা লিমিট নেই। সর্বোচ্চ ৩০০ এমবিপিএস পর্যন্ত গতির আনলিমিটেড ডেটা ব্যবহার করা যাবে। বাংলাদেশের গ্রাহকেরা আজ থেকেই অর্ডার করতে পারবেন।
ব্যয়বহুল হলেও স্টারলিংকের মাধ্যমে প্রিমিয়াম গ্রাহকদের জন্য উচ্চমান ও উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবাপ্রাপ্তির টেকসই বিকল্প তৈরি হয়েছে বলে জানান ফয়েজ আহমদ। পাশাপাশি যেসব এলাকায় এখনো ফাইবার কিংবা দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা পৌঁছেনি, সেখানে কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ পাবে বলেন তিনি। এ ছাড়া এনজিও, ফ্রিল্যান্সার ও উদ্যোক্তারা বছরব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন উচ্চগতির ইন্টারনেটের নিশ্চয়তা পাবেন বলেও জানান।
স্টারলিংকের ইন্টারনেটে ডাউনলোড গতি ২৫ থেকে ২২০ এমবিপিএস (মেগাবাইট পার সেকেন্ড)। তবে বেশির ভাগ ব্যবহারকারী ১০০ এমবিপিএসের বেশি গতি পান। স্টারলিংকে আপলোড গতি সাধারণত ৫ থেকে ২০ এমবিপিএসের মধ্যে থাকে।
ইন্টারনেটের গতি পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের প্রতিষ্ঠান ওকলার বলছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের ব্রডব্যান্ডের ডাউনলোড গতি ছিল ৫৩ দশমিক ১২ এমবিপিএস এবং আপলোড গতি ছিল ৪৯ দশমিক ২১ এমবিপিএস। মোবাইল ইন্টারনেটে ফেব্রুয়ারি মাসে ডাউনলোড গতি ছিল ৩৭ দশমিক ৯৮ এমবিপিএস এবং আপলোড গতি ছিল ১৩ দশমিক ৩০ এমবিপিএস।
ইলন মাস্কের সঙ্গে স্টারলিংকের সম্পর্ক কী
মার্কিন ধনকুবের, উদ্যোক্তা ও ট্রাম্প প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ইলন মাস্কের ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক তথ্য ও যোগাযোগমাধ্যমে এক অভাবনীয় সংযোজন। ২০১৯ সালের মে মাসে ৬০টি স্যাটেলাইটের চালুর মাধ্যমে স্টারলিংকের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাত হাজারেরও বেশি।
পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ চালু করা প্রথম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক সার্ভিসেস, এলএলসি। পরিচালনা প্রতিষ্ঠানের নামানুসারেই উপগ্রহ ক্লাস্টারের নাম হয়েছে স্টারলিংক।
২০২১ সালের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাকেন্দ্রিক এর প্রথম বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। সে সময় প্রথম জনসাধারণের কাছ থেকে প্রি-অর্ডার নেওয়া হয়েছিল।
যেভাবে বাংলাদেশে এল স্টারলিংক
২০২৩ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশে স্টারলিংকের প্রযুক্তি এনে পরীক্ষা করা হয়। সে সময় তৎকালীন মন্ত্রীদের সঙ্গে স্টারলিংকের বৈঠকও হয়েছিল।
এরপর ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় বসার পর বাংলাদেশে স্টারলিংক আনার ব্যাপারে জোর তৎপরতা শুরু করেন। চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি স্টারলিংকের প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্কের সঙ্গে ফোনে কথাও বলেন।
পরে ২০২৪ সালের অক্টোবরে স্টারলিংকের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) অক্টোবরে একটি নির্দেশিকার খসড়াও তৈরি করে।
এরপর আজ মঙ্গলবার ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বাংলাদেশে স্টারলিংকের আনুষ্ঠানিক যাত্রার ঘোষণা দিলেন।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment