×

নোবেলরা এমন কেন, আমরা কেমন তারকা তৈরি করতে চাই

ধর্ষণ ও প্রতারণার অভিযোগে হাজতে আছেন সংগীতশিল্পী মাঈনুল ইসলাম নোবেল। এর আগেও তাঁর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন দুই স্ত্রীসহ একাধিক নারী। জনপ্রিয়তা শুধু খ্যাতির নয়, একধরনের সামাজিক আয়নারও প্রতিফলন। নোবেলর বাস্তবতা আমাদের বর্তমান সমাজের মানসিক গঠন ও মূল্যবোধের জটিলতা বোঝারও এক চমৎকার আয়না। এ ধরনের তারকাদের জনপ্রিয়তার মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছেন সৈকত আমীন

জনপ্রিয়তা একদিকে মানুষের স্বপ্নের শিখর, অন্যদিকে আত্মবিধ্বংসী পতনের প্রেক্ষাপট। মানুষ জনপ্রিয় হয় কেন? আর জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর অনেকেই কেন বিতর্কিত কাজে জড়িয়ে পড়েন? এই প্রশ্নগুলো কেবল সামাজিক নয়, মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণযোগ্য এক জটিল বাস্তবতা। আমাদের দেশের সাম্প্রতিক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দুইটি নাম সামনে আসে—হিরো আলম ও মাঈনুল আহসান নোবেল। তাঁরা দুজন ভিন্ন জগতের মানুষ হলেও খ্যাতি, বিতর্ক ও আত্মবিভ্রমের জালে তাঁরা যেন অদ্ভুতভাবে গাঁথা।

একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আত্মপ্রচারমূলক তারকা, অন্যজন প্রতিশ্রুতিশীল কণ্ঠশিল্পী থেকে একাধিক আইনি বিতর্কের মুখোমুখি হওয়া মানুষ। দুজনেই এক সময় ভীষণ আলোচিত ছিলেন, এখনও আছেন—কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন কারণে। এই আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিষয়—জনপ্রিয়তার মনস্তাত্ত্বিক চাপ এবং তার বহুমাত্রিক প্রতিক্রিয়া।

জনপ্রিয়তার মনস্তত্ত্ব

জনপ্রিয়তা মানে শুধু মানুষের ভালোবাসা পাওয়া নয়। এটা এমন এক প্রকাশভঙ্গি, যা আত্মপরিচয়ের অভ্যন্তরে গিয়ে পৌঁছায়। কেউ যখন জনসম্মুখে প্রশংসিত হন, তখন তাঁর ভেতরে আত্মসম্মানবোধ বাড়ে। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন সেই আত্মসম্মান আত্মমুগ্ধতায় রূপ নেয়।

মাঈনুল আহসান নোবেলের ক্ষেত্রে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জনপ্রিয়তা তাঁকে হয়তো একধরনের ‘অন্তর্মুখী অহং’ দিয়েছিল, যা ধীরে ধীরে তাঁকে বিশ্বাস করায়—তিনি সব নিয়ম, সব আইনের ঊর্ধ্বে। তাঁর বিরুদ্ধে নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণের অভিযোগ কেবল একটি আইনি বিষয় নয়; মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনায় এটি আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং নিজেকে ‘আইনের হাতের বাইরে’ ভাবার এক মানসিক জটিলতার বহিঃপ্রকাশ।

মনোযোগ আকর্ষণ এবং হিরো আলমের চরিত্র বিনির্মাণ

হিরো আলমের ক্ষেত্রে চিত্রটা খানিকটা আলাদা। তিনি জনপ্রিয় হয়েছেন ‘বেসুরো’ গান এবং ব্যতিক্রমী উপস্থিতির মাধ্যমে। তাঁর গান, অভিনয় বা রাজনৈতিক উচ্চারণ—সবকিছু নিয়েই আছে বিতর্ক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই বিতর্ক উৎপাদন করে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করাই তাঁর উদ্দেশ্য নয় তো?

মনোবিজ্ঞানে এক ধরনের আচরণ আছে, যাকে বলা হয় ‘অ্যাটেনশন সিকিং বিহেভিয়র’ বা  মনোযোগ আকর্ষণের প্রবণতা। এমন প্রবণতার ব্যক্তি নিজের অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে চান ‘লক্ষ্যবস্তুর’ মধ্যে থেকে। হিরো আলম প্রায়ই বলেন, ‘আমি মানুষের বিনোদনের জন্য কাজ করি।‘  এই ‘বিনোদন’ মূলত নিজেকে দৃশ্যমান রাখার এক কৌশল। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া, অদ্ভুত ভিডিও তৈরি, নাটকীয় বিবৃতি—সবই একটিমাত্র উদ্দেশ্যকে ঘিরে আবর্তিত। সেই উদ্দেশ্য হলো, ‘মানুষ আমাকে নিয়ে কথা বলুক।’

ক্ষমতা ও সামাজিক নিয়মের সংঘাত

জনপ্রিয়তা অনেক সময় জনপ্রিয় হওয়া ব্যক্তির মনে একটি ভুল ধারণা সৃষ্টি করে। তাঁরা মনে করা শুরু করে যে তাঁরা সমাজের সাধারণ নিয়ম-কানুনের বাইরে। মনোবিজ্ঞানীরা এটাকে বলেন ‘পাওয়ার-ইনডিউসড কগনিটিভ ডিসটরশন’ বা ক্ষমতাজনিত ভুল ধারণা। মাঈনুল আহসান নোবেলের ক্ষেত্রেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। বারবার সামাজিক ও আইনগত সীমা লঙ্ঘনের ঘটনা, আত্মপক্ষ সমর্থনে অহংকারী বক্তব্য এবং নিজের অবস্থানকে অপরিহার্য ভাবা—সবই এই বিকৃত ধারার ইঙ্গিত বহন করে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম: দ্রুত প্রতিক্রিয়া, দ্রুত পতন

আজকের দিনে একজন মানুষ কতটা জনপ্রিয়, তা আর কোনো টেলিভিশন চ্যানেল নির্ধারণ করে না—সেটা নির্ধারণ করে ফেসবুকের শেয়ারসংখ্যা, ইউটিউবের ভিউ আর টিকটকের ‘লাইক’। এই তাৎক্ষণিকতা একদিকে জনপ্রিয়তা অর্জন সহজ করেছে, অন্যদিকে মনস্তাত্ত্বিক চাপ অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

একজন মানুষ যখন বুঝে ফেলেন, তার প্রতিটি উচ্চারণ বা কার্যকলাপ বিশাল ভার্চ্যুয়াল জনতার চোখে বিচার হচ্ছে, তখন অনেক সময় তিনি সংবেদনশীলতার বদলে চটকদারতাকে বেছে নেন। হিরো আলম এই ডিজিটাল প্রেক্ষাপটের এক জীবন্ত প্রতিমূর্তি।

প্যারাসোশ্যাল রিলেশনশিপ: একতরফা সম্পর্কের প্রভাব

তারকাদের ঘিরে আমাদের যে অনুভূতি, তা সব সময় বাস্তব সম্পর্কের মতো নয়। বরং সেটি অনেক সময় ‘প্যারাসোশ্যাল রিলেশনশিপ’ বা কল্পিত সামাজিক সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায়। যার মূলে থাকে একতরফা আবেগ। কেউ কেউ নোবেলকে আজও ‘ভালো গায়ক’ মনে করেন। একইভাবে হিরো আলমের ভক্তদের একটি বড় অংশ তাঁকে ‘আনকনভেনশনাল আইকন’ হিসেবে বিবেচনা করে।

এই অনুভূতি ভক্তদের একধরনের মানসিক নিরাপত্তা দেয়। ভক্তরা মনে করেন, ‘আমার তারকা যেমনই হোক, সে আমারই।’

নোবেল ও  হিরো আলম—দুজনই আমাদের সময়ের একেকটি প্রতিচ্ছবি। জনপ্রিয়তার বৃত্তে তাঁরা ঘুরপাক খাচ্ছেন এবং আমরা দর্শক হয়ে তাকিয়ে আছি; কখনো সমর্থনে, কখনো তিরস্কারে।

আসলে দুজনই জনপ্রিয় হতে চেয়েছিলেন। জনপ্রিয় হওয়ার ইচ্ছা খারাপ কিছু না। আমরা সবাই চাই যে কেউ একজন বলুক, ‘তুমি দারুণ করছ!’

কিন্তু সমস্যাটা হয় যখন কেউ নিজের সীমা ভুলে যায় বা নিজের কাজের জন্য দায় নিতে আগ্রহী হয় না। যেমন নোবেল। পশ্চিমবঙ্গের সংগীতের আসর ‘সারেগামাপা’-এর শীর্ষে গিয়ে তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, ‘আমার জনপ্রিয়তা এতই যে আইনের ধার আমার না ধারলেও চলবে। স্ত্রীকে আঘাত করলে কেউ কিছু বলবে না, প্রেমিকাকে গর্ভপাত করাতে বললেও সবাই মাফ করে দেবে। কারণ, আমি সারেগামাপাজয়ী নোবেল।’

আর হিরো আলম কী ভাবতে পারেন? তিনি নিশ্চয়ই ভেবেছেন, সবাই তো তাঁকে নিয়ে হাসে, কিন্তু ওই হাসির মাধ্যমেই তো বিখ্যাত হওয়া যায়! তাই তিনি যা-ই করেন, সেটার ভেতর একটা হিসেব থাকে—কীভাবে মানুষকে তাঁর মনোযোগের ‘টার্গেট’ করে রাখা যায়।

নোবেল বা হিরো আলমের জনপ্রিয়তা কেবল একক অর্জন নয়, এটি আমাদের সমাজের সম্মিলিত মানসিক গঠন থেকে জন্ম নেয়। আমাদের আবেগ, হাস্যরস, প্রতিক্রিয়া—সব মিলিয়েই এই বিতর্কিত চরিত্রদের তৈরি করে।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে জনপ্রিয়তার চূড়ায় থাকা মানুষগুলো সব সময় বিপদের মুখে থাকে। কারণ, সেখান থেকে পতন যেমন দ্রুত হয়, পতনের শব্দ হয় তার চেয়েও জোরেশোরে।

হিরো আলম আর নোবেল—তাঁরা আমাদের সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। একজন গরিব ঘরের ছেলে, যিনি হাস্যকর কর্মকাণ্ড দিয়ে বিখ্যাত হতে চান। আরেকজন ‘পশ্চিমবঙ্গের সার্টিফিকেটধারী’ বড় মঞ্চের গায়ক, যিনি নিজের প্রতিভা দিয়ে সব পেতে পারতেন, কিন্তু গানের চেয়ে বারবারই যেন তিনি নারী নির্যাতনে বেশি আগ্রহী।

এই দুজনের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কীভাবে সমাজ মানুষকে গড়ে, আবার ভাঙেও

আমরা যদি এই দুজনের জীবনের গল্পে চোখ রাখি, তাহলে নিজেদেরও একটু দেখে নিতে পারি। আমরা কাকে তারকা বানাচ্ছি? কেন গুরুত্ব দিচ্ছি? তারকারা যদি ভুল করে, আমরা কি সেটার জবাব চাই? নাকি শুধু হাসি আর কৌতুকে মশগুল হয়ে,  মিম বানিয়ে, ট্রল করে সব মাফ করে দিই?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সহজ নয়। কিন্তু প্রশ্নগুলো নিয়ে এখনই যদি আমরা না ভাবি, তাহলে ভবিষ্যতের তারকারা হয়তো আরও বেশি বেপরোয়া উঠবেন। আর সমাজে ‘আমরা’ হয়ে উঠব আরও বেশি দায়িত্বহীন।

নোবেল ও হিরো আলম—এই দুই চরিত্র হয়তো ভবিষ্যতের পাঠ্যপুস্তকে থাকবে না। এই দুই চেহারা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আমাদের জিজ্ঞেস করে, আমরা কেমন তারকা তৈরি করতে চাই? কেমন সমাজ গড়তে চাই? জনপ্রিয়তা কি শুধু বিনোদনের বিষয়, নাকি এটি একটি নৈতিক দায়িত্বেরও অধ্যায়?

 

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

পূর্ববর্তী পোস্ট

গারো পাহাড়ে বন্য হাতির পৃথক আক্রমণে দুই রিকশা-ভ্যানচালকের মৃত্যু

পরবর্তী পোস্ট

ইসি পুনর্গঠন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে এনসিপির বিক্ষোভ, তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি

Post Comment