সহনশীলতা কি এবার টিকে থাকবে রাজনীতির মঞ্চে
শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে কথা বলছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষত সাম্প্রতিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের শপথগ্রহণকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও নতুন রাজনৈতিক শক্তি বিতর্কে জড়িয়ে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরলেও সহিংস আচরণ করছে না। এই পরিবর্তন কি আমাদের রাজনৈতিক উত্তরণের আভাস দেয়? লিখেছেন রাতুল আল আহমেদ
দেড় যুগের স্বেচ্ছাচারী শাসন শেষে গণঅভভুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। দেশে জেগে উঠেছে গণতন্ত্রের প্রতি নতুন আশাবাদ, বেড়েছে মতপ্রকাশের অধিকারচর্চার আকাঙ্ক্ষা।
নব্বইয়ের দশকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশ নতুন করে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রবেশ করে। এর আগে এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দল জোট বেঁধে তখন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেমেছিল। তখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও পারস্পরিক সৌজন্য ও সম্মানবোধ ছিল স্পষ্ট।
উৎসব-পার্বণে একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানানো এবং সংসদে শালীন বিতর্কের সংস্কৃতি ছিল রাজনৈতিক আচরণের অংশ। এমনকি ১/১১-এর সময়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া কারাগারে থাকাকালে একে অপরের জন্য খাবারও পাঠিয়েছিলেন।
নব্বই দশকের পর ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবনতির সূচনাবিন্দু। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ দল নির্বাচন বর্জন করে। ফলে ১৫৩টি আসনে কোনো ভোট ছাড়াই জিতে যায় আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থীরা। ফলে আওয়ামী লীগ কার্যত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ই রয়ে যায় ক্ষমতায়।
প্রধান বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন, রাজপথে সহিংসতা, বিদেশিদের উদ্বেগ ও জনগণের আস্থাহীনতা এই নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। এখান থেকেই তীব্র হয় রাজনৈতিক মেরুকরণ। তখন বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের তরফ থেকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একদলীয় শাসনের অভিযোগ তোলা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে নিরাপত্তা বাহিনীকে বিরোধী দল ও মতকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। র্যাবের বিরুদ্ধে গুম-খুনের অভিযোগ এবং বিচারবহির্ভূত দমন-পীড়নের ঘটনা রাজনীতির পথকে আরও কঠিন করে তোলে। শতাধিক বিরোধী নেতা-কর্মীর গুমের অভিযোগ, বিচার বিভাগকে দলীয়করণ এবং ভিন্নমতের ওপর দমন-পীড়ন, সব মিলে বিরোধী মতের লোকেরা একপ্রকার ‘উনমানুষ’ হয়ে উঠেছিল তৎকালীন বাস্তবতায় । সরকারি দমন-পীড়নের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ছিল ‘আয়নাঘর’-এ নির্যাতন।
জনগণের ক্ষোভ ক্রমাগত জমতে জমতে একসময় বিস্ফোরিত হয়। নীরবতার বুক চিরে গত বছর জুলাই মাসে শিক্ষার্থী ও জনতার গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই ওই বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটে। তখন থেকে জনগণ ‘নতুন বাংলাদেশ’ বলতে একটি মুক্ত ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কথা বোঝে।
‘ফ্যাসিবাদ পরবর্তী’ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ছিল রাজনৈতিক বিতর্কের ভাষা ও কাঠামোর পরিবর্তন। সহনশীলতা ও যুক্তির ভিত্তিতে মতপার্থক্য তুলে ধরার সংস্কৃতি আবার মাথা তুলতে শুরু করেছে। উদাহরণ হিসেবে বর্তমানে ইশরাক হোসেন ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার মধ্যকার রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কের কথা বলা যেতে পারে। পরস্পরকে রাজনৈতিক আক্রমণ করলেও তাঁরা একে অপরকে ব্যক্তি আক্রমণ থেকে বিরত রয়েছেন। হাসিনা আমলে যা অকল্পনীয় ছিল।
অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী-জনতার একটি অংশ প্রথমে জাতীয় নাগরিক কমিটি নামে একটি প্লাটফর্ম গড়ে তোলে। তাঁদের মতে ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করবেন। পরে তাঁদের একটি অংশ নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামের এই দল নিজেদের মধ্যপন্থী বলে দাবি করছে।
অনেকেই আশা করছেন, নতুন রাজনৈতিক দলের এই যাত্রা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারায় শুভ সূচনা ঘটাবে।
বর্তমানে রাজনীতিতে সক্রিয় দলগুলো সহিংসতা নয় বরং পশ্চিমা সংস্কৃতির ‘পলিটিক্যাল ডায়লগের’ মতো যুক্তিনির্ভর প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছে। যেই সংস্ক্রিতি শেখ হাসিনার আমলে ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছিল।
ঢাকার সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে অবস্থানগত পার্থক্য থাকলেও তা শান্তিপূর্ণভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে বৈধতা দেওয়া আদালতের রায় ঘিরে জটিলতা তৈরি হলেও এর বিরোধীরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ করছে।
এনসিপি একদিকে চায় দক্ষিণ করপোরেশনের প্রশাসক বহাল থাকুক, আবার গণ অধিকার পরিষদ প্রশাসকের পদত্যাগ দাবি করছে। বিএনপি চাইছে ইশরাকের শপথগ্রহণ। অপরের মতামতকেও গ্রাহ্য করার মানসিকতা গড়ে উঠছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এসব মতপার্থক্য থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো সহিংস হয়ে উঠছে না। সহিষ্ণু এই পরিবেশকে অনেকেই গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন।
বাংলাদেশ থেকে অতীতের দমনমূলক রাজনীতি, গুম-খুন এবং একনায়কতান্ত্রিক আচরণ বিদায় নেবে বলে অনেকে আশা করছেন। আর এখনকার বাস্তবতা হলো, রাজনীতির ময়দানে মত-দ্বিমত আছে, তর্ক-বিতর্ক আছে, কিন্তু সহিংসতা নেই। বিরোধিতা আছে, তবে তা যুক্তিসংগত ও শান্তিপূর্ণ। গণতন্ত্র যে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার খেলা নয়, বরং ভিন্নমতের সহাবস্থানে সমাজ গঠনের প্রক্রিয়া, অভ্যুত্থান পরবর্তী বাস্তবতায় তার প্রতিফলন কিছুটা হলেও দেখা যাচ্ছে।
সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলকেও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার শিক্ষা দেয়। নতুন বাংলাদেশ যদি সত্যিই এই মূল্যবোধ ধারণ করে, তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে কিন্তু বৈরিতা নয়। বিতর্ক থাকবে, সহিংসতা নয়।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment