×

আজও বব ডিলান: যেদিন তিনি ইলেকট্রিক গিটার হাতে প্রথম মঞ্চে উঠেছিলেন

আজ বব ডিলানের জন্মদিন। ১৯৪১ সালের ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া এই নগরবাউল ছয় দশক ধরে গানে গানে বলেছেন চলতি সময় ও সমাজের কথা। আজ ফিরে তাকানো যাক ১৯৬৫ সালের ২৫ জুলাইয়ের সেই সন্ধ্যায়। যেদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে ‘নিউপোর্ট ফোক ফেস্টিভ্যাল’-এ ইলেকট্রিক গিটার হাতে দেখা মিলেছিল ‘অচেনা’ এক ডিলানের। কী ঘটেছিল সেদিন? কীভাবে তাঁর সংগীতের ভাষা ও গতি নতুন মোড় নিয়েছিল। লিখেছেন গৌতম কে শুভ

বিশ্বের সংগীত ও পপ কালচারের ক্যানভাসে বব ডিলান এক নায়কের নাম। তাঁর প্রভাব পেরিয়েছে ভাষা, দেশ ও প্রজন্মের গণ্ডি। দুনিয়াজুড়ে ৬০ বছর ধরে বেজে যাচ্ছে তাঁর গান। এই শিল্পীর বেশির ভাগ জনপ্রিয় গানের জন্মই সেই ১৯৬০-এর দশকে। সেই সময়ে ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড, ‘দ্য টাইমস দে আর আ-চেঞ্জিং’ বা ‘এ হার্ড রেইন’–এসব গানগুলো নাগরিক অধিকার ও যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের ‘জাতীয় সংগীত’ হয়ে দাঁড়ায়।

ডিলানের গানযাত্রার শুরু লোকসংগীতের মাধ্যমে। তবে সেখানেই তিনি থেমে থাকেননি। বরং লোক ধারার সংগীত থেকে এগিয়েছেন লোকাশ্রিত রক, ব্লুজ, রক এমনকি কান্ট্রি মিউজিকের দিকেও। সব ধারাতেই তিনি হয়ে উঠেছেন চলতি সময়ের দলিল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাহিত্যে পেয়েছেন নোবেলও।

আজ ২৪ মে বব ডিলানের জন্মদিন। সংগীতপ্রেমীরা দিনটাকে শুধুই কেক কাটার মুহূর্ত হিসেবে দেখেন না, বরং দেখেন সময়-গড়ার শিল্পীকে স্মরণ করার উপলক্ষরূপেও। তাই তো এই দিনে ফিরে তাকাতে ইচ্ছা করে ১৯৬৫ সালের ২৫ জুলাইয়ের সেই সন্ধ্যার দিকে, মার্কিন মুলুকের ‘নিউপোর্ট ফোক ফেস্টিভ্যাল’-এ। যেদিন ডিলান প্রথমবার ইলেকট্রিক গিটার হাতে মঞ্চে উঠেছিলেন।

তারপর? ডিলানের সংগীত জগৎ যেন বড়সড় মোড় নিল। কিন্তু সেদিনের ডিলান ছিলেন এক ‘অন্য ডিলান’। এভাবে তাঁকে আগে কখনো আর দেখা যায়নি! কী হয়েছিল সেদিন?

নিউপোর্ট ফোক ফেস্টিভ্যালে তরুণ বব ডিলান। ছবি: সংগৃহীত

চেনা গানে অচেনা ডিলান

কনসার্টে দেখতে আসা হাজারো লোকসংগীতপ্রেমীরা তখন এক কবির গান শোনার অপেক্ষায়। মনে মনে ভাবছেন, এই বুঝি হাতে অ্যাকুস্টিক গিটার আর গলায় হারমোনিকা ঝুলিয়ে মঞ্চে উঠবেন ডিলান। একটু পরেই হয়তো শুরু হবে ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’।

কিন্তু সে সময় কী করছিলেন তরুণ ডিলান? তিনি তো ইলেকট্রিক গিটার হাতে মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে তিনি একেবারে উল্টোটা ভাবছেন। ‘লাইক এ রোলিং স্টোন’গানটা অ্যালবামের মতোই রক-স্টাইলে করতে হবে। নতুন গান।  মাত্র  পাঁচ দিন আগেই বাজারে এসেছে। প্রথমবারের মতো লাইভে গাওয়া হবে। এ গান দিয়েই ডিলানের রক ধারার গানের সূচনা।  ইতিহাসের চোখ দিয়ে দেখলে এটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তো বটেই।

তো ডিলান সেদিন মঞ্চে উঠলেন। তবে সবাই অবাক! অ্যাকুস্টিক গিটার কই! তাঁর সঙ্গে আছেন ‘বাটারফিল্ড ব্লুজ’ব্যান্ডের মাইক, স্যাম লে আর জেরোম আর্নল্ড। আবার পিয়ানোবাদক আল কুপারও হাজির।

গাওয়া শুরু করলেন ডিলান, ‘ম্যাগি স ফার্ম’। কিন্তু দর্শকদের তেমন সাড়া নেই। গান শেষে হাততালির শব্দ খুবই কম। শোরগোল শোনা যাচ্ছে। কেউ কেউ চিৎকার করে বলছে, একটু আগেই মঞ্চ মাতানো পপ গায়িকা ‘কাজিন এমি’কে আবার ফিরিয়ে আনো।

যখন তিনি ‘লাইক আ রোলিং স্টোন’  নামের দ্বিতীয় গান শুরু করলেন, অবস্থা আরও বেগতিক। দর্শকসারি থেকে ভেসে আসতে লাগলো, ’ফোক গান গাও’, ‘তুমি বিক্রি হয়ে গেছো’, ‘এটা তো ফোক ফেস্টিভ্যাল’। পেশাদারী সংগীতজীবনে এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম ডিলানের।

কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই ‘ইট টেকস আ ট্রেন টু ক্রাই’ গানটাও শেষ করলেন। হাততালি একদম নেই। বিপরীতে আছে অনেক বেশি দুয়োধ্বনি। এবারে ডিলান ও তাঁর দল মঞ্চ ছেড়ে চলে গেলেন। সুনসান নীরবতার মধ্যে টের পাওয়া যাচ্ছে ফোক-ভক্তদের হতাশা। ঘড়ির কাঁটা কি থেমে গেছে?

এবার কী হবে? ডিলানের পারফর্ম করা শেষ! তখন এগিয়ে এলেন ফোক দুনিয়ার প্রিয়মুখ পিটার ইয়ারো। ডিলানকে অনুরোধ করলেন মঞ্চে ফিরে আসার। আর হাতে তুলে দিলেন সেই পুরোনো সঙ্গী, অ্যাকুস্টিক গিটার।

ডিলান একা মঞ্চে ফিরে এসে বুঝলেন, তাঁর যে স্কেলের হারমোনিকা লাগবে, সেটা তো সঙ্গে নেই। দর্শকরা ‘ট্যামবুরিন ম্যান’ গাইতে অনুরোধ করলেন। ডিলান বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমাদের জন্য ওটাই গাই।‘

ডিলান আবার দর্শকদের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনাদের কারো কাছে কি ‘ই’ স্কেলের হারমোনিকা আছে? ২০ সেকেন্ডের মধ্যে কে যেন মঞ্চে ছুড়েও মারল সেটা। শুরু হলো গান। শেষে চেনা সেই মুহুর্মুহু করতালি। তাঁদের চেনা ডিলান ফিরে এসেছেন!

এ উৎসবে শেষ গান হিসেবে ডিলান গাইলেন, ‘ইটস অল ওভার নাও, বেবি ব্লু’। সেদিন কি কেউ বুঝতে পেরেছিল, যে অন্য ডিলানকে আজ তারা দেখল, এই ডিলান ফোক গানকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেবেন ‘ফোক-রক’ দিয়ে?

কেন পিট সিগার ডিলানের সাউন্ড সিস্টেমের তার কাটতে চেয়েছিলেন

ডিলানের গান পরিবেশনায় শুধু দর্শকরাই নয়, অস্বস্তিতে পড়েছিলেন অনেক ফোক সংগীত শিল্পীও। তাঁদের অনেকেই ছিলেন ডিলানের গানের আদর্শগত বন্ধু। সেই দলে ছিলেন কিংবদন্তি ফোক গায়ক পিট সিগারও। সেদিনের কনসার্টের অন্যতম আয়োজক সিগারই।

অনেক দিন ধরে একটা গল্প বেশ প্রচলিত ছিল। ডিলানের পারফরম্যান্স চলাকালে রাগে-ক্ষোভে সিগার নাকি বলেছিলেন, ‘আমার হাতে যদি কুড়াল থাকত, তাহলে ডিলানের মাইক্রোফোনের কেবলের তার কেটে দিতাম।‘

অনেক বছর পর পিট সিগার এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছিলেন। আসল কাহিনি একটু অন্যরকম। খুবই বাজে ‘সাউন্ড সিস্টেম’ ছিল সেদিন, বিশেষত ডিলানের সময়। একটা শব্দও ঠিকমত বোঝা যাচ্ছিল না। সিগার সাউন্ড সিস্টেমের এই হালের জন্য খুব বিরক্ত হয়ে কথাটি বলেছিলেন। অর্থাৎ তিনি ডিলানের এই নতুন রূপান্তরের বিপক্ষে ছিলেন না। তাঁর ক্ষোভ ছিল প্রযুক্তিগত। একজন সাউন্ড-পারফেকশনিস্টের মনোভাব থেকে।

অবশ্য কনসার্টের সাউন্ড সিস্টেমকে একমাত্র দোষ হিসেবে দেখার উপায় নেই। মাত্র এক রাতের অনুশীলনে ডিলান নতুন পরিচয় হওয়া চারজনের সঙ্গে স্টেজে ওঠেন। তা-ও আবার প্রথমবারের মতো ইলেকট্রিক গিটার হাতে। অন্যদিকে কনসার্টের সময়স্বল্পতার জন্য সাউন্ড চেক করার সময়ও পাননি।

ডিলান কেন রক সাউন্ডের দিকে এগোলেন

এখানে ‘এগোলেন’ মানে ফোককে পাশ কাটিয়ে রক সংগীতের (মূলত ফোক-রক) দিকে ঝুঁকলেন, ব্যাপারটা এমন নয়। গল্পটা সময়ের সঙ্গে নতুন সাউন্ড তৈরির। ডিলানের শিকড়ই তো ফোক সংগীত। তিনি ‘উডি গাথরি’ দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত। উডিকে নিজের ‘গানবাবা’ মনে করতেন। পল রোবসন আর পিট সিগারও তাঁর ভাবনায় প্রভাব রেখেছে। সেই পরম্পরা থেকেই ডিলানের গানে এসেছে রাজনৈতিক বার্তা, সাধারণ মানুষের কথা ও প্রতিবাদের সুর।

ডিলানের এই রূপান্তর নিয়ে রক সংগীত গবেষক এলিজা ওয়াল্ড তাঁর ‘ডিলান গোজ ইলেকট্রিক’ বইতে বিশদে লিখেছেন। এই বই অবলম্বনেই ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ‘আ কমপ্লিট আননোন’ নামে সিনেমা হয়। অস্কারের বেশ কয়েকটি শাখায় মনোনয়নও পেয়েছে সিনেমাটি।

ডিলানের রকের দিকে ঝুঁকে পড়া নিয়ে বুঝতে গেলে তাকাতে হবে ষাটের দশকের একদম শুরুর দিকে। যখন বিলবোর্ডের শীর্ষ ১০ অ্যালবামের মধ্যে ৬-৭টাই থাকত ফোক গানের! এরপর ঘটল ‘বিটলস-ঝড়’। রক মিউজিকের জন্য তৈরি হতে লাগলো বিশাল ভক্তকূল। ১৯৬৪ সালে বিটলস হিট হওয়ার পর ফোক দুনিয়ার অনেকেই মনে করলেন, তাঁদের জায়গাটা বুঝি হারিয়ে যাচ্ছে। ‘ফোক মিউজিক মুভমেন্ট’ শেষ।

তুমুল জনপ্রিয়তার ফোক-কালেও ডিলান রক সংগীতকে হালকা কিছু ভাবেননি। বিটলসের গান খুব পছন্দ করতেন। আর ভালোবাসতেন ‘রক অ্যান্ড রোল’। তিনি মনে করতেন বিটলস কেন পিওর ‘রক এন রোল’ করল না।

১৯৬৪ সালে ‘দ্য অ্যানিম্যালস’ ব্যান্ড প্রচলিত ফোক গান ‘হাউস অব দ্য রাইজিং সান’কে নতুনভাবে হাজির করল। ডিলানের প্রথম অ্যালবামেও গানটি ছিল। নতুন এই ভার্সন শুনে ডিলান বুঝেছিলেন ফোক গানও রকেও করা যেতে পারে। তারপরের ঘটনা তো আমাদের জানাই। ডিলান গান বাঁধলেন। হলেন ফোক-রকের নগরবাউল।

ডিলান শুধু ‘প্রতিবাদী গায়ক’ বা ‘ফোক গায়ক’ হয়ে একটি ধারাতে থাকতে চাননি। ডিলান নিজেই বলেছিলেন, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চেয়েছিলেন। একইসঙ্গে খুঁজছিলেন এমন এক ভাষা, যেখানে তাঁর আবেগ, বেদনা, রাগ—সবকিছুই আরও জোরালোভাবে প্রকাশ পাবে। তাঁর মনে হয়েছিল ইলেকট্রিক গিটার, ড্রামস আর পুরো ব্যান্ড সেটআপ দিয়ে গান করার মানে শুধু শব্দ বদল নয়। একেবারে ভাবনার জায়গা থেকেও নতুন কিছু খোঁজা। ফলে ফোক থেকে রকের দিকে যাত্রাটা ছিল তাঁর নিজের ভেতরের টান, বাইরের কোনো চাপ নয়।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment