×

সুবর্নার শিল্পকর্ম: কড়াইল বস্তিবাসীর জীবনধারা যেভাবে পৌঁছে গেল প্যারিসে

তরুণ শিল্পী সুবর্না মোর্শেদা প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে সম্প্রতি অংশ নিয়েছেন ফ্রান্সের প্যারিসের ‘রেভেলাসিয়নস ইন্টারন্যাশনাল ফাইন ক্রাফট অ্যান্ড ক্রিয়েশন বিয়েনালে’। কড়াইল বস্তিবাসীদের জীবনধারা কীভাবে পৌঁছে গেল শিল্পের শহর প্যারিসে? জানাচ্ছেন গৌতম কে শুভ 

একদিকে গুলশান, আরেক দিকে বনানী – এই দুই অভিজাত এলাকার মাঝখানে থাকা কড়াইল বস্তি যেন ঢাকার হৃদয়ে থাকা এক অবহেলিত পালক। কিন্তু সেই কড়াইলই এবার সরাসরি উঠে এসেছে প্যারিসের আন্তর্জাতিক শিল্পমঞ্চে। ফেলে দেওয়া স্ন্যাকস প্যাকেট, পুরোনো কাপড়, জংধরা লোহা আর পলিথিন; এসবই হয়ে উঠেছে শিল্পের প্রতীক।   

বাংলাদেশ এবার প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছে ফ্রান্সের প্যারিসের গ্রাঁ পালে আয়োজিত ‘রেভেলাসিয়নস ইন্টারন্যাশনাল ফাইন ক্রাফট অ্যান্ড ক্রিয়েশন বিয়েনালে’। আর এই পথচলার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন কিউরেটর ও শিল্পী সুবর্না মোর্শেদা। বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক এই শিল্প-উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে এ বছরের ২১ থেকে ২৫ মে পর্যন্ত।

সুবর্না শিল্পপ্রকল্পের নাম ‘অ্যাগেইনস্ট অল অডস দ্য কড়াইল ক্রনিকলস’। দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের সহায়তায় সুবর্ণা মোর্শেদার এই প্রকল্পে কড়াইলের জীবন উঠে এসেছে ভিন্ন এক ভাষায়। উৎসবের উদ্বোধন করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। বিশ্বের ৪০০ জন শিল্পীর সঙ্গে বাংলাদেশের সুবর্নার এই অংশগ্রহণ ছিল বিরাট ঘটনা।   

৩টি স্থাপনাশিল্প

রেভেলেশনস দ্বিবার্ষিকীতে দর্শনার্থীরা বাংলাদেশের তিনটি স্থাপনাশিল্প উপভোগ করেছেন। ‘ফিনিক্স অব রিনিউয়াল’, ‘কুইল্টস অব রেজিলিয়েন্স’ ও ‘থ্রেডস অব হোপ’ শিরোনামের এই তিন শিল্পকর্মে ফুটে উঠেছে কড়াইলবাসীর জীবনযুদ্ধ, সৃজনশীলতা আর আশার গল্প।

‘ফিনিক্স অব রিনিউয়াল’ হলো পাখির একটি সুউচ্চ ভাস্কর্য, যা স্ন্যাকসের রঙিন মোড়ক আর কাপড়ের অবশিষ্টাংশ দিয়ে তৈরি। পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে পাখিটি তার ডানা মেলে উড়তে চেয়েছে; যেন সে জয়ের আনন্দ ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে। এই পাখি কড়াইলের মানুষের মতোই, যারা সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ায়। আর তার ডানাগুলো বদল, মুক্তি আর এগিয়ে চলার প্রতীক, শিল্পকর্মের বিবরণে বলা হয়েছে এভাবেই। 

বাংলার ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে ‘কুইল্টস অব রেজিলিয়েন্স’-এ । এই স্থাপনাশিল্প কড়াইলবাসীর পারস্পরিক সম্পর্ক, ভালোবাসা ও সংকটের মধ্যে তুলে ধরে একসঙ্গে থাকার মানসিকতাকে। এখানে সেলাইয়ের প্রতিটি রেখা যেন তাদের জীবনগাঁথার ছন্দ, বলেছেন শিল্পী। 

আর এই বস্তিবাসীর আশার গল্প ফুটে উঠেছে ‘থ্রেডস অব হোপ’ নামের শিল্পকর্মে। কড়াইলের ভেতর থেকে পাওয়া পরিত্যাক্ত জিনিস দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এটি। যেখানে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয়েছে তারা, হৃদয় আর ঘরের চিহ্ন। কেন এভাবে প্রতীকায়িত করা হয়েছে, শিল্পী দিয়েছেন তার ব্যাখ্যাও। তাঁর ভাষ্যে, তারা হলো স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার, যা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। আর হৃদয় ভালোবাসা ও বন্ধনের চিহ্ন। ফলে এই শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে শিল্পী কড়াইলবাসীর জীবন-বাস্তবতা ও আকাঙ্ক্ষার গল্প তুলে এনেছেন। 

সংকটের মধ্যে সৃজনশীলতা 

সুবর্না মোর্শেদা কড়াইল এর আগেও কাজ করেছেন কড়াইলে। সেখানকার সরু গলিতে হাঁটতে হাঁটতে তিনি দেখতে পেয়েছেন বিচিত্র কিছু–যেমন পথকুকুরের নাম রাখে শিশুরা, নারীরা প্রতিকূলতার মধ্যে জীবন সাজায় নতুনভাবে। কড়াইলের শিশুদের নিয়ে ‘প্রসঙ্গটা ঘরের’ শিরোনামে একটি বই ও ছাপচিত্র কর্মশালার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। এখানে নিজের মতো করে ঘর এঁকেছিল শিশুরা। সেই ঘর, সেই মানুষ আর তাঁদের স্বপ্ন আরও বড় ক্যানভাসে এবার হাজির হয়েছে প্যারিসের প্রদর্শনীতে।

এভাবে ভিন্ন চোখে দেখার ভাবনাই সুবর্ণার শিল্পকে সীমানার বাইরে নিয়ে গেছে। সহশিল্পী মো. সাজিদুল হকের অংশগ্রহণে এ প্রকল্প আরও বর্ণময় হয়েছে, বলেছেন শিল্পী। শিল্পপ্রকল্পটি একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক দর্শকদের মুগ্ধ করেছে, তেমনি প্রশ্ন ছুঁড়েছে সমাজের প্রতিও। 

‘এগেইনস্ট অল অডস’ আন্তর্জাতিক মঞ্চে আলো ছড়ালেও সুবর্নার চোখ এখন আরও দূরে। শিল্পের মধ্য দিয়ে নিজের দেশকে তুলে ধরার পাশাপাশি কিছু প্রশ্নও তুলতে চান তিনি।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment