মৃত্যুদণ্ড, আপিল ও খালাস: আজহারুল ইসলামের ১৩ বছরের কারাজীবনে যা যা ঘটল
তুফায়েল আহমদ
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগের এই রায়ের পর তাঁর মুক্তিতে আর কোনো আইনি বাধা নেই বলে জানিয়েছেন তাঁর আইনজীবী শিশির মনির ও অন্যান্য সদস্যরা।
২৭ মে মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করে। রায়ের পর শিশির মনির জানান, আজহারুল ইসলামকে সব অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের ‘সিন্ডিকেটেড ইনজাস্টিস’-এর অবসান ঘটেছে এবং বিচার বিভাগের মর্যাদা আরও সুসংহত হয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আজহারুলের আপিলের শুনানি ৬ মে শুরু হয়ে ৮ মে শেষ হয়। সেদিন রায় ঘোষণার জন্য ২৭ মে ধার্য করেন আদালত।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রিভিউ আবেদনের ভিত্তিতে এই প্রথমবারের মতো কোনো আসামিকে আপিলের মাধ্যমে খালাস দেওয়া হলো।
গ্রেপ্তার ও অভিযোগ
২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে। এই সময় তদন্ত কর্মকর্তারা ৬০ জনেরও অধিক ব্যক্তির বক্তব্য গ্রহণ করেন। তবে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ২৭ জনকে সাক্ষী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালের ৮ জুলাই ধানমণ্ডিস্থ তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান জানান যে, আজহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিষয়ে তদন্ত শেষ হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে দাখিল করার জন্য প্রসিকিউশনের কাছে তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দিয়েছেন তাঁরা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ভিত্তিতে ২০১২ সালের ২২ আগস্ট ঢাকার মগবাজারে নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হন আজহার । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর অঞ্চলে ১২৫৬ ব্যক্তিকে গণহত্যা ও হত্যা, ১৭ জনকে অপহরণ, একজনকে ধর্ষণ, ১৩ জনকে আটক, নির্যাতন ও গুরুতর জখম এবং শতশত বাড়ি-ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো নয় ধরনের ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। ২০১২ সালের ১২ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচারকাজ শুরু করেন।
সাক্ষীরা যা বললেন
২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দশম সাক্ষী রতন চন্দ্র দাস নিজের সাক্ষ্য প্রদান করেন। ৬১ বছর বয়সী এই সাক্ষী জানান, তাঁর উপস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ১৫ বৈশাখ রংপুরের কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক কালাচাঁদ বাবুর বাড়ি থেকে কালাচাঁদ বাবু, তাঁর স্ত্রী মঞ্জুশ্রী ও অপর শিক্ষক সুনীল বাবুকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মি ও চার-পাঁচজন বাঙালি, যাদের মধ্যে আজহারুল ইসলামও ছিলেন।
২০১৪ সালের ২৬ আগস্ট যুক্তি উপস্থাপনের সময় আজহারের বিরুদ্ধে ক্যামেরা ট্রায়ালে সাক্ষ্য দেওয়া বীরাঙ্গনার জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ। বীরাঙ্গনার অভিযোগ, রংপুর টাউন হলের পাকিস্তানি ও রাজাকার ক্যাম্পে আজহারের নেতৃত্বে ধর্ষণ ও নির্মম নির্যাতনের শিকার হন তিনি। সেসময় বীরাঙ্গনা দুই মাসের অন্ত্বঃসত্তা ছিলেন উল্লেখ করে তুরিন আফরোজ বলেন, ‘এ নির্যাতনে আজহারের বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ পায়। ওই সাক্ষীসহ অন্য নারীদের ওপর তিনি যে নির্যাতন চালান, তাতে বোঝা যায়, তিনি পশু ছাড়া কিছুই ছিলেন না।’
বিচারে যা হলো
দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম মামলার রায় ঘোষণা করেন। প্রসিকিউশনের উত্থাপিত ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আদালত আজহারকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। রায় শুনে আজহার বিচারকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এটা ফরমায়েশি রায়। আমি নির্দোষ। আল্লাহর আদালতে আপনাদের বিচার হবে ইনশাল্লাহ।’ তাঁর আইনজীবীরা মামলাটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেন। সে সময় এই রায়ের প্রতিবাদে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দুই দিনের হরতাল ঘোষণা করে।
২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি ১১৩টি যুক্তি উপস্থাপন করে এটিএম আজহারের খালাস চেয়ে আপিল করা হয়। আপিল বিভাগে ৯০ পৃষ্ঠার মূল আপিল এবং ২৩৪০ পৃষ্ঠার সংযুক্ত দলিল জমা দেওয়া হয়।
এই আপিলের শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদের নেতৃত্বে চার বিচারপতির একটি বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় প্রদান করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে দুই, তিন, চার ও ছয় নম্বর অভিযোগে দণ্ড বহাল রাখা হয়, তবে পাঁচ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়।
২০২০ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। এরপর ওই বছরের ১৯ জুলাই আজহারুল ইসলামের পক্ষ থেকে রিভিউ আবেদন জমা দেওয়া হয়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগ ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা কারামুক্ত হলেও আজহারুল ইসলাম তখনো কারাগারে বন্দি ছিলেন।
২০২৫ সালের ৯ জানুয়ারি রিভিউ আবেদনের বিষয়টি আদালতে উত্থাপন করেন এটিএম আজহারের পক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক। তিনি আদালতে বলেন, আসামি দশ বছর ধরে মৃত্যুর সেলে রয়েছেন, তাই রিভিউ শুনানি জরুরি। আদালত আবেদন গ্রহণ করে ২৩ জানুয়ারি শুনানির দিন নির্ধারণ করেন।
রিভিউ শুনানির শেষে ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার অনুমতি দেন এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে সংক্ষিপ্তসার জমা দিতে বলেন। পরবর্তীতে সংক্ষিপ্তসার জমা দেওয়ার পর শুনানি অনুষ্ঠিত হয় এবং আজ আপিল বিভাগ রায় ঘোষণা করেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের খতিয়ান
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ এসেছে ৮৩৩টি, যার মধ্যে ৮৯টি অভিযোগের তদন্ত শেষ হয়েছে। এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ৪৪টি এবং ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে ১১টি মামলার রায় এসেছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে শীর্ষ পর্যায়ের ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। ছয় আসামির মধ্যে পাঁচজনই জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় নেতা।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন ৩০টি মামলা বিচারাধীন। রাষ্ট্রপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বিচারাধীন ৩০টি মামলায় আসামি ১৭২ জন। অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের করা ৫০টির বেশি আপিল এখন সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment