আন্দোলনে উত্তাল সচিবালয়: কী আছে নতুন অধ্যাদেশে, কেন প্রত্যাহারের দাবি
মো. ইসতিয়াক
অন্তর্বর্তী সরকারের জারি করা ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। সচিবালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই অধ্যাদেশকে ‘কঠোর ও একতরফা’ আখ্যা দিয়ে টানা কর্মবিরতি, অবস্থান ধর্মঘট ও বিক্ষোভ চলছিল।
প্রথম থেকে নবম গ্রেডের কর্মকর্তারা মনে করছেন, এই আইন কার্যকর হলে তাঁদের সাংবিধানিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও পেশাগত নিরাপত্তা গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ন হবে।
গতকাল সোমবার (২৬ মে) সকাল থেকে সারা দিন সচিবালয়ের ভেতর ও আশপাশের এলাকায় সরকারি কর্মচারীরা জড়ো হয়ে স্লোগান, প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন ও বিক্ষোভ করেন। সেই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবারও আন্দোলনের রেশ কাটেনি। আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দিয়েছেন—যতদিন না এই অধ্যাদেশ বাতিল হচ্ছে, ততদিন কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে। এতে প্রশাসনিক কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে, যার প্রভাব সরকারের নীতিনির্ধারণী কাজেও পড়ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সব শেষ আজ মঙ্গলবার (২৭ মে) বেলা পৌনে তিনটায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সচিবদের সঙ্গে আন্দোলনরত নেতাদের বৈঠকের পর কর্মসূচি এক দিনের জন্য স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ভূমি সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদের সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে আরও পাঁচজন সচিব উপস্থিত ছিলেন। তার আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে জরুরি বৈঠকে অধ্যাদেশ পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয় এবং ভূমি সচিবকে আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আন্দোলনের সূত্রপাত ও বর্তমান চিত্র
গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ সংশোধনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকেই কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করে। এরপর শনিবার (২৪ মে) গেজেট আকারে অধ্যাদেশটি জারি হলে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। ২৬ মে সোমবার সকাল থেকেই সচিবালয়ের প্রধান ফটকে অবস্থান নেন সরকারি কর্মচারীরা। একপর্যায়ে মূল ফটকগুলো কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। শ্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে সচিবালয়, যেখানে জনপ্রশাসন সচিবের বিরুদ্ধেও স্লোগান দিতে দেখা যায় বিক্ষুব্ধ কর্মচারীদের।
আজ মঙ্গলবার আন্দোলনের চতুর্থ দিনে সচিবালয়ের ভেতরে আরও শক্ত অবস্থানে দেখা যায় আন্দোলনকারীদের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কড়া নিরাপত্তা বলয়ে সচিবালয় ঘিরে রাখে। কর্মসূচি চলাকালে সাংবাদিকদের সচিবালয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। বেলা একটার আগে পর্যন্ত সাংবাদিকদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। একটার পর সাংবাদিকদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় এবং তখন আন্দোলনের নেতাদের একজন মুহা. নুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের সামনে বক্তব্য দেন। তিনি বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান ও সচিবালয় কর্মকর্তা কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের একাংশের সভাপতি।
তখন মুহা. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আজকের কর্মসূচি সফলভাবে পালন করেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত এই অধ্যাদেশ বাতিল না হচ্ছে, ততক্ষণ আমাদের আন্দোলন চলবে। ভবিষ্যতে এটি আরও তীব্র হবে। আমরা প্রয়োজন হলে আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে দেব।’ সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এটি মত প্রকাশের অধিকারের লঙ্ঘন।’
অধ্যাদেশে শাস্তি, ক্ষমতা ও আপিলের বিধান
নতুন এই অধ্যাদেশে সরকারি কর্মচারীদের চারটি আচরণকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, যেগুলো হলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ অমান্য বা অনানুগত্য প্রদর্শন, সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি করা, ছুটি না নিয়ে বা যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া একক বা দলগতভাবে অনুপস্থিত থাকা এবং অন্যকে উস্কানি দিয়ে কাজে বাধা দেওয়া বা বিরত রাখা। এসব আচরণকে ‘অসদাচরণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে এর জন্য তিন ধরনের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে—চাকরি থেকে বরখাস্ত, চাকরি হতে অব্যাহতি এবং বেতন ও পদমর্যাদার (গ্রেড) অবনমন।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উঠলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কিংবা ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি অভিযোগ গঠন করে সাত কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করবেন। কর্মচারী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জবাব দিলে তা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। জবাব সন্তোষজনক না হলে, অথবা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জবাব না এলে, কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশে উল্লেখিত যে কোনো একটি শাস্তি দিতে পারবেন।
তবে এখানেই শেষ নয়—শাস্তিপ্রাপ্ত কর্মচারী চাইলে ত্রিশ কার্যদিবসের মধ্যে আপিল করতে পারবেন। তবে আপিলের বিষয়টি রাষ্ট্রপতির আদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ, রাষ্ট্রপতির আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না বরং দণ্ডপ্রাপ্ত কর্মচারী শুধু পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারবেন রাষ্ট্রপতির কাছে। এই ‘রিভিউ আদেশ’ই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে গণ্য হবে, যা আর কোনোভাবে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।
এই ধারাগুলোতে যেভাবে কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্তগ্রহণে প্রায় একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেটিকে অনেকেই নিয়ন্ত্রণমূলক এবং কর্তৃত্ববাদী বলে বিবেচনা করছেন।
কেন কর্মচারীরা এই অধ্যাদেশের বিরোধী
অন্দোলনরত কর্মচারীরা দাবি করছেন যে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫ তাঁদের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করার লক্ষ্য নিয়েই প্রণীত হয়েছে। কর্মচারীরা আশঙ্কা করছেন, এই অধ্যাদেশ কার্যকর হলে তাঁরা আর সভা-সমাবেশ, ধর্মঘট কিংবা কর্মবিরতির মাধ্যমে তাঁদের অধিকার ও দাবি আদায় করতে পারবে না। অধ্যাদেশে এমন বিধান রয়েছে যে কোনো কর্মচারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রতিবাদ বা সংগঠিত আন্দোলন পরিচালনা করেন, তবে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এতে কর্মচারীদের ভয় হচ্ছে যে তাঁরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন এবং তাঁদের সংগঠন করার স্বাধীনতাও সীমাবদ্ধ হবে। তা ছাড়া অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ঊর্ধ্বতনের অন্যায় বা অবৈধ আদেশকেও বাধ্য হয়ে মানতে হবে, অন্যথায় চাকরি থেকে অব্যাহতি বা শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের কো-চেয়ারম্যান মো. বাদিউল কবীর বলেন, ‘এই অধ্যাদেশ প্রয়োগ করবেন কর্মকর্তা পর্যায়ের কর্তৃপক্ষ, আর ভুক্তভোগী হবেন সাধারণ কর্মচারীরা। এতে কর্মচারীদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে এবং তাঁরা নিপীড়নের শিকার হবেন। কর্মচারীদের ওপর ক্ষমতার অপব্যবহার বাড়বে, যা তাদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা এবং মানসিক চাপে পরিণত হবে।’
আইনগত ও নৈতিক বিতর্ক
সরকারি কর্মচারীরা কি তাহলে জবাবদিহিতার বাইরে থাকবে? এমন প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের জন্য এর আগেও শৃঙ্খলা বজায় রাখার নানা বিধান ছিল। দুর্নীতির জন্য দুদক, আর আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-ই যথেষ্ট বলে মনে করেন অনেকে। তাহলে আলাদাভাবে কেন এই অধ্যাদেশ? প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান। তাঁর মতে, গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্রের জন্য এমন দমনমূলক অধ্যাদেশ প্রাসঙ্গিক নয়।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘আইনে অবশ্যই শৃঙ্খলা থাকা দরকার, কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, নিরপেক্ষ তদন্ত এবং যুক্তিসঙ্গততা নিশ্চিত না থাকলে সেটি অবিচার সৃষ্টি করবে। অনেক কর্মচারী সংগঠনের নেতাদের ভয়ে আন্দোলনে যান। কারণ, নেতারা সচিব ও মন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলে।’
এ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের মনে করেন, সরকারি চাকরিতে শৃঙ্খলা আনতে গিয়ে যেন স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার সংকুচিত না হয়। এই অধ্যাদেশে যে পরিমাণ প্রশাসনিক ক্ষমতা একতরফাভাবে কর্মকর্তাদের হাতে দেওয়া হয়েছে, তা প্রশাসনিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে।’

প্রেক্ষাপট ও প্রশাসনিক অস্থিরতা
গত বছর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রশাসনে একাধিক ঘটনায় অস্থিরতা তৈরি হয়। বিশেষ করে বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে পদোন্নতি ও মর্যাদাভিত্তিক বৈষম্য নিয়ে অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করে। ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা ফেসবুকে লেখালেখির কারণে বরখাস্ত হন এবং তখন থেকেই ক্ষোভ জমতে থাকে। গত ডিসেম্বরে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ঘিরে প্রশাসন ক্যাডার ও অন্য ক্যাডারদের মধ্যে বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়। এরপর সচিবালয়ে হাতাহাতি, রুমে তালা লাগানোর মতো ঘটনা ঘটে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এই অধ্যাদেশ আনতে বাধ্য হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে আন্দোলনরত কর্মচারীদের মতে, বিদ্যমান সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-তে শৃঙ্খলা রক্ষার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। নতুন করে অধ্যাদেশ এনে মতপ্রকাশ ও সংগঠনের অধিকার খর্ব করা যুক্তিসংগত নয়। সরকার চাইলে সংশ্লিষ্ট বিধিমালার মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে পারত।
সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ বনাম ২০২৫ অধ্যাদেশ
২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনে কর্মচারীদের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষায় বেশ কিছু সুরক্ষামূলক বিধান ছিল। যেমন ফৌজদারি মামলা করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমতি বাধ্যতামূলক ছিল (ধারা ১২), যা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হয়রানি থেকে সুরক্ষা দিত। কিন্তু ২০২৫ সালের সংশোধিত অধ্যাদেশে এই অনুমতির বিধান শিথিল বা পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে, যার ফলে যেকোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলার প্রক্রিয়া আরও সহজ হয়ে গেছে এবং এর ফলে অনৈতিক চাপ বা হয়রানির আশঙ্কা বেড়েছে।
এ ছাড়া, শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় ২০১৮ সালের আইনে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন ও ধারাবাহিকতা (ধারা ২০–৩০) মেনে চলার বাধ্যবাধকতা ছিল, যা সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করত। কিন্তু নতুন অধ্যাদেশে এই নিয়মগুলো দুর্বল করা হয়েছে, যার ফলে দ্রুত এবং নির্বিচারে শাস্তি দেওয়ার পথ খুলে গেছে। শ্রমিক-সংগঠন গঠন ও ধর্মঘটের অধিকার যেখানে আগের আইনে সীমিতভাবে হলেও স্বীকৃত ছিল, সেখানে ২০২৫ সালের অধ্যাদেশে এসব অধিকার কার্যত খর্ব করা হয়েছে। কর্মবিরতি, ধর্মঘট বা সমাবেশের মাধ্যমে দাবি তোলার চেষ্টা করলে কঠোর শাস্তির বিধান যোগ করা হয়েছে। সর্বশেষ, শাস্তির ধরণ ও প্রক্রিয়াতেও বড় পরিবর্তন এসেছে—২০১৮ সালের আইনে যেমন গ্রেড অবনমন বা বরখাস্তের মতো শাস্তিগুলো কার্যকর করতে সময় ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হতো (ধারা ৩৫–৪০), কিন্তু ২০২৫ সালের অধ্যাদেশে এসব শাস্তি দ্রুত ও সহজে কার্যকর করার বিধান রাখা হয়েছে, যা পূর্বের আইনের তুলনায় অনেক বেশি কঠোর এবং কর্মচারীদের নিরাপত্তাহীনতার কারণ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। ফলে এই পরিবর্তনগুলো কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ ও অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment