×

রেস্তোরাঁ কর্মচারী থেকে যেভাবে শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে উঠলেন সুব্রত বাইন

ইন্টারপোলের রেড নোটিশধারী শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন অবশেষে গ্রেপ্তার হয়েছেন সেনাবাহিনীর একটি গোপন অভিযানে। কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুরে দেড় মাস ধরে ছদ্মবেশে থাকা সুব্রতকে আজ মঙ্গলবার ভোরে গ্রেপ্তার করা হয়। কুষ্টিয়া থেকে রবিউল আলম ইভানের অনুসন্ধানে পড়ুন সুব্রত বাইনের আদ্যোপান্ত।  

ঢাকার অপরাধ জগতের অন্যতম কুখ্যাত নাম সুব্রত বাইন। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। একসময় রাজধানীর মাফিয়া-রাজনীতির অন্দরে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন তিনি। সম্প্রতি কুষ্টিয়ায় সেনাবাহিনীর শ্বাসরুদ্ধকর এক অভিযানে অবশেষে গ্রেপ্তার হলেন এই ‘ছায়াসন্ত্রাসী’।

আজ মঙ্গলবার (২৭ মে) ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালায় সেনাবাহিনী। তিন ঘণ্টাব্যাপী এই অভিযান ঘিরে গোটা এলাকা ছিল উত্তপ্ত। অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় সুব্রত বাইনকে, যিনি দাড়ি রেখে ছদ্মবেশে একটি ভাড়া বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আটক হয়েছেন আরও তিন সহযোগী—মোল্লা মাসুদ, শুটার আরাফাত ও শরীফ। 

কে এই সুব্রত বাইন

সুব্রত বাইন একসময় রাজধানী ঢাকার অপরাধ জগতের এক পরিচিত নাম ছিল। চাঁদাবাজি, খুন, অস্ত্র ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ—সবকিছুতেই ছিল তাঁর সরাসরি সম্পৃক্ততা। নব্বইয়ের দশকে তিনি বনে যান ভয়ংকর এক ‘ডন’। ওই সময়ে ঢাকার মগবাজারের বিশাল সেন্টার ঘিরে উত্থান হয় সুব্রত বাইনের। তিনি এই বিপণিবিতানের কাছে চাংপাই নামে একটি রেস্তোরাঁ কর্মচারী ছিলেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে অপরাধজগতের সঙ্গে জড়িয়ে যান। পরে বিশাল সেন্টারই হয়ে ওঠে তার কর্মকাণ্ড পরিচালনার কেন্দ্র। এ জন্য অনেকে তাকে ‘বিশালের সুব্রত’ নামেও চেনেন। ২০০১ সালের পর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

সুব্রত বাইন কুখ্যাত ‘মাকসুদ-সুজন-সুব্রত’ ত্রয়ীর একজন। এই ত্রয়ী একসময় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তাঁর নামে বহু খুন ও অস্ত্র মামলার নথি রয়েছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, অন্তত ২০টিরও বেশি মামলায় তিনি পলাতক ছিলেন।

ভারতে পালিয়ে যাওয়া ও ‘ছায়া-ফিরে আসা’

২০০৪ সালে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ এবং পরবর্তী সন্ত্রাস দমন অভিযানের মুখে আত্মগোপনে চলে যান সুব্রত বাইন। এরপর ভারতে পালিয়ে গিয়ে কলকাতা ও দার্জিলিংয়ের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার রেকর্ডেও তাঁর নাম ছিল। অভিযোগ রয়েছে, সেখান থেকেই তিনি বাংলাদেশে অপরাধচক্র নিয়ন্ত্রণ করতেন।

সম্প্রতি বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ভারত থেকে একে একে দেশে ফিরছেন বহু পুরোনো সন্ত্রাসী, যাঁরা একসময় রাজনৈতিক পালাবদলের সুযোগে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের একজন সুব্রত বাইন।

ভোররাতের নিঃশব্দ অভিযান

মঙ্গলবার (২৭ মে) ভোর ৫টা। কুষ্টিয়ার কালিশংকরপুরের সোনার বাংলা সড়কে হঠাৎ সেনাবাহিনীর পাঁচটি গাড়ি এসে থামে। গাড়ি থেকে নেমে সেনাসদস্যরা স্থানীয় মৃত মীর মহিউদ্দিনের মালিকানাধীন তিনতলা বাড়িটি ঘিরে ফেলেন। মূল ফটকের তালা ভেঙে প্রবেশ করেন বাড়ির নিচতলায়—যেখানে দেড় মাস ধরে লুকিয়ে ছিলেন সুব্রত বাইন ও তাঁর সহযোগীরা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, প্রায় ছয় মাস খালি থাকা নিচতলার ফ্ল্যাটটি হেলাল নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি ভাড়া নিতে সহযোগিতা করেন সুব্রতকে। ভাড়া নেওয়ার সময় তারা পরিচয় দেন অনলাইন ব্যবসায়ী হিসেবে। বাড়ির মালিকের অনুপস্থিতিতে ভাড়া নেওয়া হয় ফ্ল্যাটটি।

বাসায় উঠেই তারা ইনস্টল করে সিসি ক্যামেরা, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল পাশের বাড়ির সেই হেলালের ঘরে। মূল ফটক ব্যবহার না করে তারা যাতায়াত করতেন পেছনের গেট দিয়ে। পুরো ঘরটি কার্যত হয়ে ওঠে এক নজরদারি নিয়ন্ত্রিত নিরাপদ গোপন আস্তানা।

ঘুম ভাঙা শহরবাসী, ছাত্রাবাসে আতঙ্ক

একই বাড়ির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় ছাত্ররা থাকতেন মেস করে। ভোরে নামাজের সময় গেট ভাঙার শব্দ পেয়ে ঘুম ভাঙে তাঁদের। প্রথমে ভেবেছিলেন, চোর ঢুকেছে। কিন্তু বারান্দায় গিয়ে বিস্মিত হয়ে দেখতে পান—বাড়ি ঘিরে আছে সেনাবাহিনী।

সেনাসদস্যরা দ্রুত শিক্ষার্থীদের একটি কক্ষে নিরাপদে একত্রিত করে জানান, বড় সন্ত্রাসীকে ধরতে অভিযান চলছে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

সুব্রত বাইন গ্রেপ্তার: ঘর থেকে গাড়িতে

অভিযান চলাকালীন সকাল ৮টার দিকে এক শিক্ষার্থী জানান, একটি কালো মাইক্রোবাস বাড়ির সামনে আসে। কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, সেনাবাহিনীর সদস্যরা এক দাড়িওয়ালা ব্যক্তিকে হাতকড়া পরিয়ে এবং অন্য এক যুবককে হাত বাঁধা অবস্থায় গাড়িতে তুলছেন। এরপরই নিশ্চিত হওয়া যায়, ধরা পড়েছেন সুব্রত বাইন।

পরিকল্পনার ছাপ: সিসি ক্যামেরা ও তথ্যনিয়ন্ত্রণ

তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, এই আস্তানাটি ছিল সুব্রতর একটি সেফ হাউজ, যা শুধু জোন নির্ধারণ করে সাজানো হয়নি, বরং পুরো বাড়িকে সিসি ক্যামেরায় নিয়ন্ত্রণের ভেতরে রাখা হয়। মূল গেট, পাশের বাড়ির দেয়াল, এমনকি তার ঘরের ভেতর পর্যন্ত ছিল ক্যামেরা ফিড। সবই নিয়ন্ত্রণে রাখতেন হেলাল নামের সেই সহযোগী।

গোপন অভিযান, প্রশাসনের স্তম্ভিত প্রতিক্রিয়া

অভিযান সম্পর্কে স্থানীয় পুলিশ জানে না বলেই জানিয়েছেন কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের মুখপাত্র। ওসি মোশাররফ হোসেন জানান, সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি, কিন্তু তাঁরা কিছু বলেননি।

প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, সুব্রতর গ্রেপ্তার ছিল দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতকৃত একটি গোপন অপারেশনের ফল।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা, রাজধানীতে সাম্প্রতিক কিছু চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী হামলার পেছনে সুব্রত বাইন ও তাঁর নেটওয়ার্কের হাত রয়েছে। তাঁর গ্রেপ্তার তাই প্রশাসনের কাছে এক বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সুব্রতর মতো শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে ঢাকার অপরাধচক্রকে ভেঙে ফেলা সম্ভব হবে।

অতঃপর সেনাবাহিনীর সংবাদ সম্মেলন

কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকায় আনার পর আজ মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় সংবাদ সম্মেলনে আইএসপিআরের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী জানান, প্রায় ৩ ঘন্টা অভিযান চলে কুষ্টিয়ার, তবে কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী বলনে, ‘তাদের ধরতে দীর্ঘদিন ধরেই গোয়েন্দা অনুসন্ধান চালছিল।’ তবে সুব্রত বাইন ও তাঁর সহযোগীরা কতদিন ধরে দেশে অবস্থান করছেন কিংবা তাদের পরিকল্পনা কী ছিল তা নিয়ে বিস্তারিত কছিু বলেননি আইএসপিআরের পরিচালক। 

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment