১৪ বছরের আইনি লড়াইয়ে অবসান, চাকরি ফিরে পেলেন ৯৮৮ জন
স্ট্রিম প্রতিবেদক
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিচ্যুত ৯৮৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে চলে আসা এক জটিল ও সংবেদনশীল আইনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অবশেষে সরকারি কর্মচারীরা ফিরে পাচ্ছেন তাঁদের চাকরি। ২০০৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০০৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী এবং প্রকাশিত স্মারক অনুযায়ী এই ৯৮৮ জন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়—যার মধ্যে এমএলএসএস থেকে ডেপুটি রেজিস্ট্রার পর্যায় পর্যন্ত পদ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আজ মঙ্গলবার (২৭ মে) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ এই ঐতিহাসিক রায় দেন।
কিন্তু ২০১১ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা অভিযোগ করলে আদালতের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় তাঁদের নিয়োগকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে জরুরি সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমে তাঁদের চাকরিচ্যুত করা হয়।
আইনি লড়াইয়ের দীর্ঘ ইতিহাস
চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কর্মকর্তারা ২০০৪ সালে সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়ার মাধ্যমে একটি রিট করেন। তবে ২০০৬ সালের ২২ আগস্ট হাইকোর্ট রুল খারিজ করে রায় দেন।
পরে গাজীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক ২০১০ সালের ডিসেম্বরে সেই রায়ের পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন। শুনানি শেষে ২০১১ সালে হাইকোর্ট ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুতির নির্দেশ দেন। এরপর ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে রায় দেন। সেই রায়ের ভিত্তিতেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের চাকরিচ্যুত করে।
চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা ২০১২ সালে আপিল বিভাগের অনুমতির (লিভ টু আপিল) আবেদন করেন। দীর্ঘদিন শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ১৯ মে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। এরপর প্রায় এক দশক পর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি রিভিউ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
আন্দোলনের পথ ও প্রশাসনের ভূমিকা
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চাকরিচ্যুত ব্যক্তিরা চাকরি ফেরতের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। এই দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনও।
গত ৯ সেপ্টেম্বর সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়কালে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে চাকরি হারানো ৯৮৮ জন কর্মকর্তার চাকরিতে পুনর্বহাল চেয়ে আপিল করা হবে। পরে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে আপিল করার অনুমতি (লিভ) দেয় আপিল বিভাগ।
আজকের রায়ে আপিল বিভাগ জানান, এই ৯৮৮ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া যথাযথ ছিল এবং চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্ত ছিল অনিয়মতান্ত্রিক ও আইনবহির্ভূত। আদালত পূর্বের (২০১৬ সালের ১৯ মে) রায় বাতিল করেছেন এবং হাইকোর্টের রায়ও বাতিল করেছেন, যার ফলে নিয়োগ পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়েছেন।
আদালতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সালাহ উদ্দিন দোলন, মো. আসাদুজ্জামান ও মো. রুহুল কুদ্দুস শুনানিতে ছিলেন। অপর পক্ষে (চাকরিচ্যুতদের) ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খায়ের এজাজ মাস্উদ।
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী যাঁরা জীবিত আছেন, তাঁদের সবাই চাকরিতে পুনর্বহাল হবেন। এই সময়টিকে “অসাধারণ ছুটি” হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তাঁদের জ্যেষ্ঠতাও বিবেচনায় থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁদের মানবিক দিক বিবেচনায় সুবিধাদি নির্ধারণে স্বাধীন থাকবে।’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী দ্রুত পুনর্বহাল প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট নিয়োগ ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়াগুলো পুনর্মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করা হবে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment