×

নগুগির তত্ত্বে বাংলাদেশের বাস্তবতা: আমি কি নিজের দেশেই পরবাসী

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর তত্ত্ব শুধু উপনিবেশের ইতিহাস নয়, আমাদের আজকের জীবনের গভীর সংকটের কথাও বলে। বাংলাদেশের মতো স্বাধীন দেশেও ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বিদেশি আধিপত্য কতটা বাস্তব, সেটাই বুঝতে সাহায্য করে তাঁর চিন্তা। সেই তত্ত্বের ভেতর ফুটে ওঠে আমাদের মানসিক পরাধীনতার চিত্র। আজ মৃত্যুদিনে তাঁর স্মরণে বিস্তারিত জানাচ্ছেন শতাব্দীকা ঊর্মি

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ঢাকায় আসে রাজীব মিয়া। বরিশালের এক অতি সাধারণ গ্রামের ছেলে তিনি। ভর্তি হয়েই বন্ধুরা তাঁকে দেখলে বলতে শুরু করে ‘মনু ডাইলে লবণ দেসো?’ তিনি দেখলেন এখানকার মানুষের চেয়ে তাঁর ভাষা আলাদা, কথার স্বর আলাদা, চলাফেরার ভঙ্গিও যেন ‘অন্য জগতের’। ক্লাসে ‘প্রমিত’ উচ্চারণ করতে না পারায় তাঁকে কিছুটা অন্য চোখে দেখা হয়। তখন তাঁর মনে হলো, ‘আমি কি নিজের দেশেই পরবাসী?’

রাজীব মিয়ার এই প্রশ্নই আসলে সদ্যপ্রয়াত আফ্রিকান লেখক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর বিউপনিবেশায়ন তত্ত্বের মূল কেন্দ্র। আজ ৮৭ বছর বয়সে মারা গেছেন আফ্রিকান এই লেখক। ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’ বইয়ে তিনি বলেছেন, উপনিবেশ মানে কেবল ভৌগোলিক নয়—এটি ভাষা, মন ও সংস্কৃতির গভীরে প্রবেশ করে।
ঢাকার মতো বহুসংস্কৃতির শহরেও রাজীব মিয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মানসিক উপনিবেশের জালে কতটা বন্দী আমরা।

নগুগির জীবনের গল্প: জেল, ভাষা ও প্রতিরোধ
নগুগি ছিলেন কিকুয়ু জাতিগোষ্ঠীর সন্তান। প্রথমে তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন ইংরেজি ভাষায়। তবে অচিরেই বুঝতে পারেন, এই ভাষা তাঁর জনগণের নয়। এরপর ইংরেজি ছেড়ে নিজের কিকুয়ু ভাষায় লেখালেখি শুরু করেন তিনি। এই ভাষাতেই লিখলেন নাটক ‘আমার যখন ইচ্ছে তখন বিয়ে করব’। আর কিকুয়ু ভাষায় নাটক লিখে কপালে জুটল কারাবাস। কারাগারে থাকাকালে নগুগি ঠিক করেন, তিনি আর ইংরেজিতে লিখবেন না। মাতৃভাষাই হবে তাঁর জীবনের হাতিয়ার। তাঁর সংগ্রাম দেখিয়ে দেয়—ভাষা কেবল সাহিত্যের বিষয় নয়, এটি অস্তিত্বের লড়াই।

পরিচয়ের দ্বন্দ্ব: নিজেকে ভুলে যাওয়া
নগুগি বলেছেন, ভাষা ধ্বংস করা মানে মানুষের আত্মপরিচয় ধ্বংস করা। বাংলাদেশেও এক শ্রেণি বড় হচ্ছে এমনভাবে, যেখানে তাদের মনে হয়, ‘বাংলায় ভাবা’ হলো একরকম পিছিয়ে পড়া। এই শ্রেণি নিজের সংস্কৃতি, গান, গল্প, ইতিহাস থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন। তারা ‘আধুনিক’ হতে গিয়ে ভুলে যাচ্ছে কারা তারা, কোথা থেকে এসেছে। এটাই নগুগির ভাষায় ‘মানসিক উপনিবেশ’।

বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা দুটি ভাগে—বাংলা মাধ্যম ও ইংরেজি মাধ্যম। ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শিশুদের সামনে থাকে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন, আর বাংলা মাধ্যমে পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ভবিষ্যৎ অস্পষ্ট। একইভাবে চাকরি বাজারেও দেখা যায়—ইংরেজি জানা চাকরিপ্রার্থীরাই অগ্রাধিকার পায়। নগুগির মতে, এটি একটি সাংস্কৃতিক দাসত্ব—যেখানে নিজ ভাষা জানলে লজ্জা, অন্য ভাষা জানলে গর্ব। বাস্তব জীবনে এটি সমাজে বৈষম্য ও বিভাজন সৃষ্টি করে।

মিডিয়া ও বিনোদন বনাম জীবনের প্রতিচ্ছবি
বাংলাদেশের টিভি বিজ্ঞাপন, সিনেমা, মিউজিক ভিডিওতে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ছায়া স্পষ্ট। একজন শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, কৃষক—তাঁদের জীবনের বাস্তবতা এসব মাধ্যমে খুব কমই উঠে আসে। নগুগি বলেছিলেন, যদি জনগণের বাস্তব গল্প না বলা হয়, তবে সেই শিল্প মানসিক উপনিবেশের অংশ হয়ে যায়। বাংলাদেশে গণমাধ্যমে শহুরে জীবনের গ্ল্যামার, পাশ্চাত্য ফ্যাশন আর ইংরেজি-প্রেমই বেশি জায়গা পায়। জীবনের আসল গল্প—সংগ্রাম, বেঁচে থাকা, ঘাম—বঞ্চিত থেকে যায়।

জীবনের উপনিবেশ মুক্তি চায়
নগুগি ওয়া থিয়ংঙ্গোর জীবন ও তত্ত্ব বলে শুধু রাজনীতিতে নয়, জীবনের প্রতিটি স্তরে উপনিবেশ বিরাজ করে। বাংলাদেশে আজও শহর-গ্রাম, ইংরেজি-বাংলা, আধুনিক-পেছিয়ে এই বিভাজন বাস্তব জীবনে মানুষের সম্মান, সুযোগ ও আত্মপরিচয় নির্ধারণ করে।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment