×

জীবনের মঞ্চে হুমায়ূন ফরীদি: নেশা, নিরীক্ষা আর শূন্যতার নায়ক

আজ ২৯ মে। অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির জন্মদিন। শিকড় থিয়েটারে আর তাঁর বিস্তার টেলিভিশন নাটকে। তারপর নিজেকে ভেঙেছেন মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমাতে। অসাধারণ চরিত্র নির্মাণে তিনি দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর জীবনপথ ছিল বেশ নাটকীয়। বাউণ্ডুলে এক যুবক থেকে হুমায়ুন ফরীদির অভিনেতা হয়ে ওঠার গল্প জানাচ্ছেন গৌতম কে শুভ

হুমায়ুন ফরীদি। যে নাম উচ্চারণ করলেই মনে পড়ে যায় দৃঢ় চাহনি, তীক্ষ্ণ সংলাপ কিংবা শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকা চরিত্রের নীরব হাহাকার। কিন্তু হুমায়ুন ফরীদি যখন নিজেকে বর্ণনা করতেন, তখন শুরুটা ঠিক নায়কের মতো শোনাত না; বরং মনে হতো এ এক অদ্ভুত জীবনের গল্প। দুরন্ত শৈশব, বাউন্ডুলে যৌবন আর শেষমেশ জীবনকে আঁকড়ে ধরার তীব্র যাত্রার কথা থাকত তাঁর গল্পে।
এই অভিনেতার জন্ম ১৯৫২ সালের ২৯ মে, পুরান ঢাকার যোগীনগরে। শৈশবে কাটিয়েছেন বাংলাদেশের নানা জায়গায়।

‘প্রত্যেকটা শহরের কিন্তু আলাদা একটা গন্ধ থাকে,’ বলেছিলেন ফরীদি। সেই গন্ধ তিনি শুঁকেছিলেন বাবার চাকরির বদলির সুবাদে নানা শহরে ঘুরে ঘুরে। সেটা কখনো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দাবার বোর্ডে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে, আবার কখনো মাদারীপুর হাইস্কুলে ক্লাস করতে করতে।
নিজের শৈশবকে বলতেন, ‘নাথিং সিগনিফিকেন্ট’। অথচ সেখানেই লুকিয়ে ছিল ভবিষ্যৎ-অভিনেতার বীজ। অভিনয়ের নেশা তাঁর ছোটবেলা থেকেই। স্কুল-কলেজ আর পাড়ার নাটকে নাম না জানা কত চরিত্রে অভিনয় করেছেন! কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর শুরু হয় তাঁর জীবনের আসল ‘নাটক’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈব রসায়ন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেমে যায় তাঁর শিক্ষাজীবন। এরপর এ-পথ ও-পথ ঘুরে কীভাবে যে হাওয়া হয়ে গেল পাঁচটা বছর! সে এক উড়নচণ্ডী-জীবন। হুমায়ুন ফরীদির ভাষায়, ‘এ সময় ড্রাগস, ড্রিংকস, গাঁজা কোনোটাই বাদ দিইনি।’

কখনো শ্মশানে, কখনো-বা রেলস্টেশনে কাটে রাত। এই জীবনই তাঁকে হয়তো প্রস্তুত করছিল বড় কিছুর জন্য। একদিন হঠাৎই ফরীদির মনে হলো, ‘না, এবার ফিরতে হবে। লেখাপড়া শেষ করা দরকার।’

জাহাঙ্গীরনগরে হুমায়ুন ফরীদি। সংগৃহীত ছবি

যেভাবে তিনি জাহাঙ্গীরনগরে
সেই ভাবনার ফলে সত্তর দশকের মাঝামাঝি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হলেন ফরীদি। তাঁর ভর্তি হওয়ার গল্পটাও খুব নাটকীয়।
পাঁচ বছরের শিক্ষা-বিরতি শুনে অর্থনীতি বিভাগের সেই সময়কার সভাপতি মালিক হোসেন চৌধুরী বললেন, ‘ইট ইজ ইম্পসিবল। এটা হয় না।’ কিন্তু নাছোড়বান্দা ফরীদি তাঁকে বশ করেছিলেন। আর যেভাবে তিনি বশ করেছিলেন, তা-ও ছিল খুব আকর্ষণীয়।
তখন হুমায়ুন ফরীদির বন্ধুদের সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষ বা মাস্টার্সের ছাত্র। তাঁরা মালিক হোসেন চৌধুরীরে জানালেন, ‘স্যার ও খুব ভালো ক্রিকেট খেলে।’ সে সময় ক্রিকেটপ্রেমী শিক্ষক পাল্টা প্রশ্ন করলেন ফরীদিকে, ‘তোমার হায়েস্ট স্কোর কত?’ ফরীদির উত্তর ছিল, ‘স্যার সিক্সটি ফোর।’ এই ‘সিক্সটি ফোর’ শব্দবন্ধটিই ঘটাল তেলেসমতি কাণ্ড। অর্থনীতি বিভাগের কর্মকর্তার কাছে টেলিফোন করলেন মালিক হোসেন চৌধুরী। বললেন, ‘একটা ছেলেকে পাঠাচ্ছি। ওকে নিয়ে নাও ফ্যাকাল্টিতে।’

ফরীদি যখন থিয়েটারে
হুমায়ুন ফরীদির অভিনয়-জীবনের ‘প্রকৃত মঞ্চে’ প্রবেশ ১৯৭৭ সালে। জাহাঙ্গীরনগরে হলভিত্তিক নাট্য প্রতিযোগীতার মাধ্যমে। সেবারই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছিল আন্তহল নাট্য প্রতিযোগিতা। যার দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সেলিম আল দীন। তিনি শর্ত দিলেন, আন্তহল প্রতিযোগিতায় নাটক শিক্ষার্থীদের নিজেরই লিখতে হবে। আবার নির্দেশনাও দিতে হবে। ফরীদি নাটক লিখলেন। তা মঞ্চস্থও হলো।

প্রতিযোগিতায় ফরীদির নাটক বিবেচিত হলো ‘শ্রেষ্ঠ নাটক’ হিসেবে। নাটক শেষে প্রতিযোগিতার অন্যতম বিচারক নাসির উদ্দীন ইউসুফ এগিয়ে এসে বললেন, ‘আপনার নাটকটা আমার খুব ভালো লেগেছে। আপনি থিয়েটার করেন?’

‘না, সেভাবে তো করি না।’ উত্তর দিলেন ফরীদি। এবার তাঁর কাছে প্রস্তাব এল নাসির উদ্দীন ইউসুফদের ‘ঢাকা থিয়েটার’-এ যোগ দেওয়ার। এভাবে তিনি যুক্ত হলেন ঢাকা থিয়েটারে।

নিয়মিত আসা-যাওয়া শুরু করলেন নাটকের মহড়ায়। সেলিম আল দীনের ‘শকুন্তলা’ নাটকের মহড়ায় হঠাৎই একদিন তাঁকে তক্ষক চরিত্রে অভিনয় করতে বলা হলো। এটাই ফরীদির প্রথম পেশাদার থিয়েটারে অভিনয়। এরপর অভিনয় করলেন ‘কিত্তনখোলা’র ছায়ারঞ্জন চরিত্রে। তার পরের ঘটনা হলো, থেকে থিয়েটার আর ফরীদির জীবনের মাঝখানে আর কোনো পর্দা রইল না।

কানকাটা রমজান চরিত্রে হুমায়ুন ফরীদি

কেন টেলিভিশন নাটকে
থিয়েটার থেকে টেলিভিশন নাটকে হুমায়ুন ফরীদির যাত্রাটা হুট করেই। একবার ‘শকুন্তলা’ নাটক করতে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন। দেখলেন থিয়েটার অভিনেতাদের মধ্যে যাঁরা টেলিভিশন তারকা, তাঁদের জন্য এসেছে মার্সিডিজ বেঞ্জ। আর বাকিদের জন্য টেম্পু। অভিনেতা আফজাল হোসেন তখন টেলিভিশন-তারকা, আবার ঢাকা থিয়েটারেরও সক্রিয় সদস্য। তো তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো মার্সিডিজ বেঞ্জে। আর ফরীদিদের জন্য থাকল টেম্পু। এটি মানতে পারেননি হুমায়ুন ফরীদি। ভাবলেন, অভিনেতাদের মধ্যেও কেন থাকবে শ্রেণিভেদ!

নাটক শেষে আড্ডায় ফরীদি তাঁর বন্ধু আফজাল হোসেনকে বললেন, ‘আমাকে তো টেলিভিশন স্টার হতে হবে।’ তাঁর এ কথায় অবাক হয়ে আফজাল বললেন, ‘তুই তো বলিস টেলিভিশন একটা ইডিয়ট বক্স! ওখানে অ্যাক্টিংয়ের পিউরিটি নাই।’
কিন্তু ফরীদি তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। এরপর ফরীদির জন্য নাটক লিখতে শুরু করলেন আফজাল। টেলিভিশনে অভিষেক ঘটল ফরীদির। তবে সমস্যা হলো, চোঁয়াল ভাঙা, লম্বা চুল, নাক বোঁচা, রোগা কাউকে দর্শক তো নায়ক হিসেবে মানতে আগ্রহী না।
অগত্যা ফরীদি ভাবলেন, নায়ক না হয়ে আমাকে অভিনেতা হতে হবে। এভাবেই এল ‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’ নাটকের ‘সেরাজ তালুকদার’ ও ‘সংশপ্তক’-এর কানকাটা রমজানের মতো কালজয়ী নেতিবাচক চরিত্র। ‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’তে অনেক কষ্টে সবাইকে রাজি করিয়ে নেতিবাচক চরিত্র পেয়েছিলেন ফরীদি। চমকপ্রদ বিষয় হলো, তাঁর এই সিদ্ধান্তে প্রথমে তাঁকে সবাই পাগল বলেছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল, সেরাজ তালুকদার চরিত্রে অভিনয় করে হুমায়ুন ফরীদি রাতারাতি সুপারস্টার হয়ে গেছেন। নাটকের সংলাপ তখন সবার মুখে মুখে, ‘আমি তো জমি কিনি না, পানি কিনি, পানি।’

মঞ্চ ছেড়ে সিনেমায়
১৯৯০ সালে মঞ্চকে বিদায় বললেন হুমায়ুন ফরীদি। তখনো হয়তো ভাবেননি, বাংলাদেশের মূলধারার সিনেমায় তিনি হয়ে উঠবেন এক নতুন রকমের ভিলেন। যিনি দর্শকের ঘৃণা নয়, ভালোবাসা আদায় করে নেবেন। এই অধ্যায়ের শুরুটাও বেশ নাটকীয়। একটি সাক্ষাৎকারে ফরীদি নিজেই বলেছিলেন সেই গল্প। তখন ব্যবসা শুরু করেছিলেন, কিন্তু কিছুতেই সুবিধা হচ্ছিল না। একটা ছোট অফিস নিয়েছেন। হঠাৎ একদিন টেলিফোন কাজ করছে না। জরুরি টেলিফোন করার দরকার পড়ায় গেলেন এক বন্ধুর অফিসে। সেখানেই পরিচয় ঘটল শহীদুল ইসলাম খোকনের সঙ্গে।

শহীদুল ইসলাম খোকন তখন বাণিজ্যিক সিনেমার পরিচিত পরিচালক। তিনি কথায় কথায় ফরীদিকে বললেন, ‘আপনারা ফিল্ম করেন না কেন? ফিল্মের লোকদের এত ঘৃণা করেন কেন?’ ফরীদি সোজাসাপটা বলেছিলেন, ‘নায়ক ছাড়া অন্য যেকোনো চরিত্রে অভিনয় করতে আমি রাজি।’

তারপর কেটে গেল তিন মাস। হঠাৎই একদিন শহীদুল ইসলাম খোকন ফরীদিকে জানালেন, তাঁর এমন একটা মুখ দরকার, যাঁকে প্রথম দেখায় কেউ ভিলেন ভাববে না, কিন্তু পরে বুঝবে এই লোকটাই আসল খলনায়ক। ফরীদিকে তিনি অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন।
এভাবেই আসে ‘সন্ত্রাস’ সিনেমার সুযোগ। সিনেমা যখন মুক্তি পেল, পরিচালক তাঁকে নিয়ে গেলেন কুমিল্লার রাণীমহল সিনেমা হলে। ম্যাটিনি শোতে হাউসফুল। পর্দায় ফরীদি আসামাত্র দর্শকের হাততালি! ফরীদি নিজেই হতবাক, তিনি তো সিনেমার মানুষ না, অথচ মানুষ তাঁকে চেনে!

এইভাবেই শুরু হয় সিনেমায় ফরীদির অন্যরকম পথচলা। যেখানে ভিলেনও হয়ে ওঠেন তারকা। চলচ্চিত্রে খলচরিত্রে অভিনয় করা প্রসঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে ফরীদি বলেছিলেন, ‘একটা খারাপ লোককে মানুষ ঘৃণা করবে। ঘৃণা তো করছে, কিন্তু অভিনয়টাকে ভালোবাসছে। এটা আমার জীবনের সবচাইতে বড় পাওয়া।’

বাণিজ্যিক ও বিকল্পধারার সিনেমা নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি
হুমায়ুন ফরীদি খুব স্পষ্টভাবে বলতেন, তিনি অভিনয় ছাড়া আর কিছুই পারেন না। তাই এটাকেই ধরে নিয়েছিলেন জীবনের একমাত্র পথ। তবে এই পথটাও ছিল দ্বিমুখী। একদিকে ছিল আত্মার টানে করা সিনেমা, যেমন ‘একাত্তরের যীশু’ বা ‘দহন’। আরেক দিকে ছিল মূলধারার সিনেমা, যেগুলো তিনি করেছিলেন অর্থ রোজগারের জন্য।

ফরীদি কখনোই এই দুই ধারার পার্থক্য লুকানোর চেষ্টা করেননি। বরং খানিকটা আক্ষেপ করেই বলেছিলেন, ‘আমি মেইনস্ট্রিমে কাজ করেছি অর্থের জন্য। ওখানে কিছু ভালো কাজ করার চেষ্টাও করেছি কিন্তু হয় না আসলে। ইট ইজ নট পসিবল।’
মূলধারার সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে রুচির জায়গায় বারবার ধাক্কা খেয়েছেন ফরীদি। সাংস্কৃতিক দিক থেকেও পড়েছিলেন সংকটে। কারণ, যে শিল্পচেতনা তিনি লালন করেন, সেখানে এই সিনেমার চরিত্রগুলো ছিল খুবই মোটা দাগে আঁকা। কে ভালো, কে খারাপ সেটা শুরুতেই বলে দেওয়া হতো। টেকনিক্যাল দিকেও কাজ হতো থেমে থেমে। অভিনেতার শরীরী ভাষার তুলনায় ক্যামেরার ক্লোজআপকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো।

তবুও ফরীদি বিশ্বাস করতেন, সিনেমা হলো আমজনতার মাধ্যম। অর্থাৎ, সেটা মানুষের কাছে পৌঁছাতে না পারলে তার আবেদন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলেছিলেন ‘মনপুরা’ সিনেমার কথা। যেটা দুই ধারার দর্শকের কাছেই জনপ্রিয় হয়েছিল। ফরীদির মতে, সিনেমা তো এমনটাই হওয়া উচিত।

এমনকি মূল্যবোধের জায়গা থেকেও বাণিজ্যিক সিনেমাকে পুরোপুরি অস্বীকার করেননি ফরীদি। কারণ, প্রায় সব সিনেমাতেই শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হয়, মন্দ হেরে যায়। এই ইতিবাচক বার্তাটাকেই তিনি ধরে নিয়েছিলেন সিনেমার এক বিশেষ শক্তি হিসেবে।

দর্শকের রুচি যে জায়গায় নেমে গেছে বলে বাংলা সিনেমা নিয়ে যে প্রশ্ন জনপরিসরে ছিল, তার দায় কি শুধুই দর্শকের? এই প্রশ্নে ফরীদি মনে করতেন, জনরুচি তৈরির দায়িত্ব নির্মাতারা ঠিকভাবে পালন করেননি। কিন্তু অভিনেতা হিসেবে ফরীদিদের দায় নেই? তিনি সেই দায় নিজের কাঁধে নেননি। বরং অকপটে বলেছেন, তিনি শুধু বেঁচে থাকার জন্য কাজ করেছেন, কখনো প্রাণ দিয়ে আবার কখনো পেটের দায়ে। আর এই দ্বিধাময় বাস্তবতার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছেন এক বিস্ময়কর ফরীদি। যিনি অভিনয়ের নেশা-নিরীক্ষা আর ব্যক্তিগত নানা শূন্যতায় নিজেই হয়ে উঠেছিলেন শিল্প ও জীবনের মধ্যবর্তী এক অনন্য চরিত্র।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment