×

যে চুক্তির মাধ্যমে চীন ভারতের ভ্রাতৃত্ব ছেড়ে পাকিস্তানের বন্ধু হয়ে ওঠে   

একসময়ের ‘ভাই ভাই’ থেকে চীন-ভারতের সম্পর্ক ধীরে বৈরি হয়ে ওঠে। এদিকে ১৯৬৩ সালের সীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের নতুন বন্ধুত্বের সূত্রপাত ঘটে। এই চুক্তি কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে ভারতের বিরোধিতার স্পষ্ট বার্তা দেয়। এর পর থেকে পাকিস্তান-চীন সম্পর্ক হয়ে ওঠে ‘লৌহকঠিন’ বন্ধুত্বের প্রতীক। কী ছিল সেই চুক্তি?  ওয়াকার মুস্তাফার বিবিসি উর্দুর প্রতিবেদন অবলম্বনে জানাচ্ছেন রাতুল আল আহমেদ  

১৯৫০-এর দশকের জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’। স্নায়ু যুদ্ধের চূড়ান্ত সময়ে মার্কিনিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা পাকিস্তানকে চীন সন্দেহের চোখে দেখত। সদ্য প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট চীন সোভিয়েত ঘনিষ্ঠ ভারতের ওপর বেশি ভরসা করেছিল।

ফলে খুব কম মানুষই কল্পনা করতে পেরেছিল,  আগামী কয়েক দশকে পাকিস্তানের সঙ্গে দেশটি এমনই বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়াবে যে তা ‘লৌহকঠিন ভ্রাতৃত্ব’, ‘সব সময়ের বন্ধু’ হিসেবে পরিচিতি পাবে।

অ্যান্ড্রু স্মল তাঁর ‘দ্য চায়না-পাকিস্তান অ্যাক্সিস: এশিয়াজ নিউ জিওপলিটিক্স’ বইয়ে লিখেছেন, ১৯৫০ সালের শুরুতে বেইজিংয়ের নিকটতম সঙ্গী ছিল ভারত, পাকিস্তান নয়।

চীন ও ভারতের সম্পর্ক অন্তত কয়েক বছরের জন্য হলেও সম্পর্কের চূড়ায় পৌঁছেছিল। ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’ স্লোগান ছিল তার নমুনা।

চীন তো এমনকি ভারতের সঙ্গে তার সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য একে অপরের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি অদল-বদলের প্রস্তাবও করেছিল।

পশ্চিম সীমান্তে চীন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চিনকে ভারত লাদাখের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে।  ছয় বছর আগে যা বিতর্কিত এক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ভারত কাশ্মীর থেকে আলাদা করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে।

পূর্ব সীমান্তেও ম্যাকমোহন লাইন নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের বিরোধ রয়েছে। অরুণাচল প্রদেশকে ভারত নিজের অংশ বলে মনে করে। চীন তা স্বীকার করে না। চীন অঞ্চলটিকে স্বায়ত্তশাসিত তিব্বতের ‘ঝাংগান’ বলে দাবি করে।

কাশ্মীর ইস্যুকে সাধারণত ভারত ও পাকিস্তানের ভেতরের উত্তেজনা ও যুদ্ধের কারণ বলে মনে করা হয়ে থাকে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আহমদ শরীফ চৌধুরী সম্প্রতি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘কাশ্মীর এমন এক আন্তর্জাতিক সমস্যা যা পাকিস্তান, ভারত ও চীনের মধ্যে বিদ্যমান।’

রং শিং গোয়ের বই ‘টেরিটোরিয়াল অ্যান্ড কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট’ অনুযায়ী কাশ্মীরের ৪৫.৬২ শতাংশ ভারতের, ৩৫.১৫ শতাংশ পাকিস্তানের ও ১৯.২৩ শতাংশ চীনের দখলে রয়েছে।

ব্রিটিশ রাজের অবসান ও মানচিত্র নিয়ে দ্বন্দ্বের সূচনা

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে এই সমস্যার সূত্রপাত।

আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিদ ড. ইয়াকুব খান বাঙ্গাশের মতে, মহারাজা রনজিত সিংয়ের মৃত্যুর পর শিখ সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন ইংরেজরা শিখদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধের পর ১৬ মার্চ ১৮৪৬ সালে ‘অমৃতসর চুক্তি’র অধীনে কাশ্মীরের উপত্যকা জম্মুর রাজা গুলাব সিংয়ের কাছে ৭৫ লাখ রুপি মূল্যে বিক্রি করে দেয়।

বিবিসি উর্দুর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ড. বাঙ্গাশ বলেন, এভাবে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সৃষ্টি হলেও এর পূর্ব সীমান্ত নির্ধারিত হয়নি।

‘তিব্বত এবং শিনজিয়াংয়ের দিকে এই সীমান্ত ছিল বিরান ও জনশূন্য, তাই এ নিয়ে তেমন চিন্তাও ছিল না।’

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এবং লাদাখের প্রান্তে ভারত ও চীনের বিতর্কিত সীমান্ত অঞ্চল নিয়ে লেখা ‘হোয়াইট এজ দ্য শ্রাউড: ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড ওয়ার অন দ্য ফ্রন্টিয়ার্স অব কাশ্মীর’ বইতে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইরা ম্যাকডোনাল্ড লিখেছেন, যখন ভারতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এই সীমান্ত নির্ধারণের চেষ্টা করেছিল, তখন চীনা সাম্রাজ্য ছিল পতনের মুখে।

‘ব্রিটেন বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছিল তিব্বতকে। যার মধ্যে ১৮৬৫ সালের আরদাঘ-জনসন লাইন ছিল, যা আকসাই চিনের বেশিরভাগ অংশকে লাদাখের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এছাড়াও ১৮৯৯ সালের ম্যাকার্টনি-ম্যাকডোনাল্ড লাইন যা তুলনামূলক বাস্তব প্রস্তাব ছিল। তবে এই প্রস্তাবগুলো কখনও আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদন পায়নি।’

ইংরেজরা কোনো সমাধান ছাড়াই চলে গেল, রেখে গেল এক জটিল সমস্যা

লাহোরের ইনফরমেশন টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের ডিন ড. বাঙ্গাশ বলেন, ১৮৬৫ সালের আরদাঘ-জনসন লাইন থেকে শুরু করে ১৯১৪ সালের ম্যাকমাহন লাইন পর্যন্ত যে সমস্ত সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেগুলো ছিল একে অপরের থেকে আলাদা।

‘ভারতের ব্রিটিশ সরকার কখনও কোনো অঞ্চলকে জম্মু ও কাশ্মীরের অংশ বলে ঘোষণা করত, আবার কখনো ভিন্ন কোনো অঞ্চলকে। এই গোলযোগের কারণ ছিল, যদিও তিব্বতকে এই প্রক্রিয়ায় বারবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু শিনজিয়াংয়ে থাকা চীনের সরকারের সঙ্গে সীমান্ত সম্পর্কে খুব কমই আলোচনা হয়েছে।’

এই কারণেই চীন উত্তর-পূর্ব কাশ্মীরের ব্রিটিশ শাসনের সেই সীমান্ত রেখাগুলো কখনও স্বীকার করেনি এবং ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট সরকার গঠনের পরও এই অবস্থান অটুট থাকে।

বাঙ্গাশ বলেন, চীনের দাবি ছিল যে বেইজিংয়ে তাদের সরকারের কোনো কর্মকর্তা ভারতের সরকারের সঙ্গে সীমান্তসংক্রান্ত কোনো চুক্তি করেনি, না পূর্বে, না পশ্চিমে।

ম্যাকডোনাল্ড লেখেন, ‘যখন ব্রিটিশ শাসন শেষ হয়, তখন ব্রিটিশ নকশাগুলোতে আকসাই চিনের কোনো স্পষ্ট সীমানা ছিল না।’

মানচিত্রের অস্পষ্টতা ও দ্বদ্বের শুরু  

ভারত ও চীন দুই দেশই এমন সময়ে আকসাই চিনের ওপর দাবি জানিয়েছিল যখন অঞ্চলটি মূলত ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ ছিল। অ্যান্ড্রু ম্যাক্সওয়েল তাঁর বই ‘ইন্ডিয়াস চায়না ওয়ার’-এ বলছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মতে আকসাই চিন শতকের পর শতক ধরে লাদাখের অংশ ছিল।

অপর দিকে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই বলেন, পশ্চিম সীমান্ত কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নির্ধারিত হয়নি। তিনি আরও বলেন, ম্যাককার্টনি-ম্যাকডোনাল্ড লাইনই একমাত্র সীমান্ত প্রস্তাব, যা কোনো চীনা সরকারকে দেওয়া হয়েছিল। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, আকসাই চিনের কিছু অংশ চীনের সীমানার মধ্যে পড়েছিল।

চৌ এন লাই আরও দাবি করেন, আকসাই চিন ইতিমধ্যে চীনের নিয়ন্ত্রণেই আছে এবং আলোচনা চলাকালে বাস্তবতার ভিত্তিতে বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত।

অ্যাডাম জাইডান এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার জন্য তাঁর গবেষণায় লিখেছেন, চীন তিব্বত ও শিনচিয়াংয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করার পর লাদাখের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অগ্রসর হতে শুরু করে। এই আগানোর উদ্দেশ্য ছিল আকসাই চিন অঞ্চল দিয়ে একটি সামরিক সড়ক নির্মাণ করা যা ১৯৫৬–৫৭ সালে সম্পন্ন হয়।

এই সড়ক শিনচিয়াং ও পশ্চিম তিব্বতের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করে এবং চীনকে ভারত ও তিব্বতের মধ্যবর্তী কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পাসের উপর নিয়ন্ত্রণ দেয়।

জার্মান সংস্থা এসডব্লিউপির দুই গবেষক ক্রিশ্চিয়ান ভ্যাগনার ও অ্যাঞ্জেলা স্টেনজেল তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করছেন ১৯৫৯ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই একটি প্রস্তাব তুলে ধরেছিলেন। তিনি চাইছিলেন ভারত ও চীন এমন একটি সমঝোতায় পৌঁছাবে যেখানে তারা একে অপরের কিছু ভূখণ্ডের দাবির ক্ষেত্রে ছাড় দেবে।

যেমন চীন আকসাই চিন পাবে, আর ভারত উত্তর-পূর্ব ভারতের (বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ) ওপর দাবি ছেড়ে দেবে। কিন্তু ভারতের সরকার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

জাইডান লিখেছেন, ভারত বেশ দেরিতেই ওই সড়কের বিষয়ে জানতে পারে। এরপরেই দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ শুরু হয়। এই সংঘর্ষ শেষমেশ ১৯৬২ সালের অক্টোবরে চীন-ভারত যুদ্ধে রূপ নেয়। সেই যুদ্ধের পর থেকে লাদাখের উত্তর-পূর্ব অংশ চীনের নিয়ন্ত্রণে।

জার্মান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮৮ সালের পর ভারত-চীন সম্পর্ক যখন উন্নতির দিকে যেতে শুরু করে, সীমান্ত ইস্যুটি তখন আবার গুরুত্ব পায়। ১৯৯৩ সালের চুক্তির আওতায় ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ (এলএসি)-কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে এটি একটি নির্দিষ্ট রেখা নয় বরং দুইপক্ষের সম্মতিপ্রাপ্ত টহল রুট ও সামরিক চৌকির একটি এলাকা।

তবে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতের সরকার জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে বাতিল করে এবং সেটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ২০২০ সালের ৪ আগস্ট পাকিস্তান একটি নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে, যেখানে সম্পূর্ণ কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে দেখানো হয়।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুন ইং এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘সম্প্রতি ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ আইন একতরফাভাবে পরিবর্তন করে চীনের আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করেছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয় এবং এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই।’

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে চীনও লাদাখ/আকসাই চিন প্রসঙ্গে ভারতের সঙ্গে পূর্ববর্তী অবস্থান ভেঙে দেয়।

এই সব পদক্ষেপ ইঙ্গিত দেয় যে কাশ্মীর ইস্যুটি এখন এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। এর ফলে চীন ও পাকিস্তান সম্ভবত আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার দিকে এগোতে পারে।

 

পাকিস্তান-চীনের সীমান্ত চুক্তি

চীন ও পাকিস্তানের মধ্যেও কিছু সীমান্ত অঞ্চল নিয়ে বিরোধ ছিল।
ভারতের চিন্তাবিদ ও ইতিহাসবিদ এ জি নূরানি ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় ২০০৬ সালের ২০ অক্টোবর প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ১৯৫৯ সালের নভেম্বরে পাকিস্তান যখন আলোচনার প্রস্তাব দেয়, তখন চীনের তরফ থেকে এক ধরনের শীতলতা ও সন্দেহভরা মনোভাব পাওয়া যায়। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র পাকিস্তানের পরিবর্তে  ভারতকে গুরুত্ব দিত।

পাকিস্তানের সেই প্রস্তাবের জবাব দিতে চীন এক বছর সময় নেয়।  অবশেষে ১৯৬০ সালের ৮ ডিসেম্বর তার প্রতিক্রিয়া জানায়।
‘ফেসিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে ওই প্রবন্ধে বলা হয়েছে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান তাঁর আত্মজীবনী ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্সে’ লিখেছেন, ডিসেম্বর ১৯৬১ সালে চীনা রাষ্ট্রদূত পাকিস্তানের কাছে জাতিসংঘে চীনের আসনের জন্য সমর্থন চান। এর জবাবে আইয়ুব খান সীমান্ত সমস্যা স্মরণ করিয়ে দেন।
চীনা রাষ্ট্রদূত বিষয়টিকে জটিল বলে বর্ণনা করলে, আইয়ুব খান বলেন, ‘আমাদের উচিত দুটি বিষয়কে তাদের নিজ নিজ গুরুত্ব অনুযায়ী বিবেচনা করা।’

১৯৬২ সালের ১২ অক্টোবর থেকে আলোচনা শুরু হয়।
প্রাথমিকভাবে চীনের দাবি ছিল খুনজরাব উপত্যকা ও কেটুর আশপাশের অঞ্চলগুলো। তবে পরে তারা পাকিস্তানের মানচিত্রে থাকা সীমা কিছু সংশোধনসহ মেনে নেয়। কেটু শৃঙ্গ দুই দেশের মধ্যে ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়।

পাকিস্তান দাবি করে শিমশাল পাসের ওপারে অবস্থিত কিছু চরাঞ্চল, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হুনজা বাসিন্দারা ব্যবহার করে আসছে।
চীনা প্রতিনিধিরা সম্মত হন। তারা বলেন, বিষয়টি ‘মেরিট’-এর ভিত্তিতে বিবেচনা করা হবে। পরবর্তীতে ওই এলাকা পাকিস্তানকে দেওয়া হয়। 

১৯৬২ সালের ২৭ ডিসেম্বর মূল চুক্তির ঘোষণা আসে। ২ মার্চ ১৯৬৩ বেইজিংয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ২৬ মার্চ ১৯৬৫ ভূমি সীমা চিহ্নিতকরণ প্রোটোকল সই হয়।
নূরানি লিখেছেন, চুক্তিটি কারাকোরাম ওয়াটারশেড ভিত্তিক ছিল যা ১৮৯৭ সালের আর্দাগ লাইন, ১৮৯৯ সালের ম্যাককার্টনি-ম্যাকডোনাল্ড প্রস্তাব এবং ১৯০৫ সালের কার্জন সংশোধন-এর ভিত্তিতে গঠিত।

ভারত এই চুক্তিকে ‘অবৈধ’ঘোষণা করে। ভারতের মতে, ১৯৪৭ সালের চুক্তি অনুসারে সম্পূর্ণ কাশ্মীর ভারতের অংশ।
ভারত জাতিসংঘে একটি প্রতিবাদপত্রও জমা দেয়।
পাকিস্তান তার উত্তরে জানায়, চীন এই সীমান্তকে একটি ‘অস্থায়ী ব্যবস্থাপনা’ হিসেবে মেনে নিয়েছে। কাশ্মীর সমস্যার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর তা পুনর্বিবেচনা করা হবে।

 

ভুট্টোর চীনমুখী কূটনীতি

১৯৬৩ সালের ২৬ মার্চ দেওয়া এক ভাষণে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারতের প্রতিবাদপত্র প্রসঙ্গে বলেন, ‘জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চল ভারতের অংশ নয় বরং কাশ্মীরবাসীর। এর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের ১৩ আগস্ট ও ১৯৪৯ সালের ৫ জানুয়ারির প্রস্তাব অনুযায়ী— অর্থাৎ একটি অবাধ গণভোটের মাধ্যমে।’
ভুট্টু বলেন, ‘যেহেতু ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই এই প্রস্তাব মানে, তাই এককভাবে কাশ্মীরের উপর কর্তৃত্ব দাবি করা দুঃখজনক ও অনুচিত।’
ভুট্টো আরও বলেন, ‘পাকিস্তান চীনকে এক ইঞ্চি জমিও দেয়নি বরং ৭৫০ বর্গমাইল জমি পেয়েছে। আগে তা চীনের নিয়ন্ত্রণে ছিল।’

সাবেক কূটনীতিক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সাত্তার লিখেছেন, যখন সীমান্ত নির্ধারণ চূড়ান্ত হচ্ছিল পাকিস্তান আবিষ্কার করে যে শিমশাল পাসের ওপারের কিছু চারণভূমি ঐতিহাসিকভাবে হুনজার বাসিন্দারা ব্যবহার করত।
তাই পাকিস্তান একটি ব্যতিক্রম দাবি করে। চৌ এন লাই উদারভাবে সীমান্ত সংশোধনে রাজি হন। এর মাধ্যমে ৭৫০ বর্গমাইল এলাকা পাকিস্তানে যুক্ত হয়। এসবই হয় মাঝরাতে।

অ্যান্ড্রু স্মল লিখেছেন, আইয়ুব খান সতর্ক, তবে নিশ্চিতভাবে এগিয়েছিলেন।  তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানে চীনপন্থী গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো’।
ভুট্টো আইয়ুব খানকে বলেন, তাঁর পুরনো বক্তব্য চীন-ভারত বিরোধ ‘ভারতের সমস্যা’—তা প্রত্যাহার করতে। বরং পাকিস্তানকে বেইজিংকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে যে তারা ভারতের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করছে।

চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করেছিলেন ভুট্টোর পূর্বসূরি মনজুর কাদির। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ১৯৬৩ সালের মার্চে ভুট্টো নিজেই বেইজিং যান এবং চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চেন ইর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

 

কাশ্মীর প্রশ্নে চীনের পাকিস্তানপন্থী অবস্থান

‘পাকিস্তান হরাইজন’-এ পরভেজ ইকবাল চিমা লিখেছেন, চুক্তির পর চীন কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের অবস্থানকে পূর্ণ সমর্থন দেয়।

‘চুক্তিটি চীনের দক্ষিণ সীমান্ত নির্ধারণ করে এবং ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা দূর করে। চীন সীমান্তটিকে একটি “অস্থায়ী ব্যবস্থাপনা” হিসেবে মেনে নেয়। যেন ভবিষ্যতে কাশ্মীর সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানে তা পুনর্বিবেচনা করা যায়।’ 

নুরানি লিখেছেন, ১৯৬৩ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে চীন আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, লাওস, উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনামের সঙ্গে তাদের সীমান্ত বিরোধ মিটিয়ে নিয়েছে।
কিন্তু ভারত ও ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ এখনও অমীমাংসিত।

নুরানি প্রশ্ন তোলেন, ‘আমরা কি একতরফাভাবে এই বিরোধের সমাধান করব, নাকি পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তিতে পৌঁছাবো?’  তিনি যোগ করেন, ‘কোনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি তখনই সম্ভব, যখন তা উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। আর এর মানেই হলো, দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে।’

 

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment