তামাকের দুষ্টুচক্র: মানুষ থেকে মাটি, সব জায়গায় ক্ষতি
আজ ৩১ মে, নো টোব্যাকো ডে। বিশ্বব্যাপী তামাকে ক্ষতি নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে দিনটি পালিত হয়। তবে তামাক উৎপাদন থেকে সেবনের এই দীর্ঘ পথে আছে নানা ধরনের ক্ষতি। বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে বিস্তারিত জানাচ্ছেন শতাব্দীকা ঊর্মি
সিগারেটকে আমরা সাধারণত স্বাস্থ্যঝুঁকির দিক থেকে দেখি। কিন্তু এর পেছনের কৃষি, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির চিত্র আরও ভয়াবহ। একদিকে কৃষকরা তামাক চাষে যুক্ত হয়ে পড়ছেন দারিদ্র্য ও মাটি ধ্বংসের দুষ্টচক্রে। অন্যদিকে রাষ্ট্র হারাচ্ছে মূল্যবান রাজস্ব, স্বাস্থ্য খাতে বাড়ছে ব্যয় আর পরিবেশ হারাচ্ছে ভারসাম্য।
বাংলাদেশে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রাঙামাটি, বান্দরবান, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরে জেলায় তামাক চাষ দিন দিন বাড়ছে। বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো চুক্তিবদ্ধভাবে কৃষকদের প্রলোভন দিয়ে তামাক চাষে নিয়ে আসে। কৃষককে দেওয়া হয় আগাম অর্থ, বিনামূল্যে বীজ, সার, এমনকি প্রশিক্ষণও। প্রথম দিকে লাভজনক মনে হলেও কয়েক বছর পর কৃষকের মাটি হয়ে পড়ে অনুর্বর। এই জমিতে ধান বা অন্য খাদ্যশস্য চাষ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে।
তামাক চাষের পুরো প্রক্রিয়ায় প্রচুর কীটনাশক ও বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার হয়, যা সরাসরি কৃষকের স্বাস্থ্যে আঘাত করে। গর্ভবতী নারী, শিশু ও কৃষিশ্রমিকেরা প্রতিনিয়ত তামাকের গুঁড়া, ধুলা ও বিষাক্ত পদার্থে আক্রান্ত হয়।
তামাক একটি ‘নন-ফুড ক্রপ’, অর্থাৎ খাদ্য দেয় না এমন শস্য—তাই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এটি হুমকি। ধান, আলু, গম, ডাল চাষের জমি হারিয়ে যাচ্ছে বিষাক্ত ফসলের দখলে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে তামাক খাত থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে মোট ৩২ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। কিন্তু এই স্বল্প আয় যে ব্যয়ের সাগরের তুলনায় নগণ্য, সেটি গবেষণায় স্পষ্ট। ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন ও তামাক কর বৃদ্ধি : গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এই সেমিনারের তথ্যমতে, দেশে তামাকজনিত রোগে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন। আর তামাক কোম্পানিগুলো সরকারকে যে পরিমাণ রাজস্ব দেয়, তার চেয়ে ৮ হাজার কোটি টাকা বেশি ব্যয় হচ্ছে তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায়।
তামাক শুকাতে ব্যবহার করা হয় ‘বার্নিং চেম্বার’, যার জন্য প্রতিবছর হাজার হাজার গাছ কাটা পড়ে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গে বন উজাড় করে কাঠ সংগ্রহ করা হয় তামাক শুকানোর জন্য।
তামাক চাষের জমিতে অতিরিক্ত পানি সেচ, কীটনাশক ও সার ব্যবহার করায় ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হয়। মাটি হারায় উর্বরা শক্তি। তামাক কারখানাগুলো থেকেও রাসায়নিক বর্জ্য নদী ও জলাধারে ফেলা হয়, যা মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক হুমকি।
বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী হলেও বাস্তবে আইন প্রয়োগে দুর্বল। তামাক কোম্পানিগুলো তাদের প্রভাব, লবিং ও বিজ্ঞাপন কৌশলে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করে। এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্কদের লক্ষ্য করে ফ্লেভার্ড সিগারেট ও ই-সিগারেট বাজারজাত করছে তারা।
তামাক চাষীদের জন্য বিকল্প হিসেবে উদ্ভাবনী ফসল (যেমন: সূর্যমুখী, মুগডাল, মরিচ, মৌচাষ) ও সরাসরি ভর্তুকি দিতে হবে। কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও ন্যায্যমূল্যের বাজার নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে, তামাক কোম্পানির প্রলোভনের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা এবং তামাকচাষ অঞ্চলগুলোকে ধীরে ধীরে রূপান্তর করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
তামাক কেবল ধোঁয়া নয়, এক বহুমুখী ধ্বংসচক্র। এটি কৃষকের শরীর আর মাটির রস একসঙ্গে শুষে নেয়। রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে গর্তে ঠেলে দেয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্যকে করে ক্ষতবিক্ষত। এখনই যদি তামাকবিরোধী শক্ত অবস্থান নেওয়া না হয়, তাহলে একদিন সিগারেট শুধু ফুসফুস নয়, পুরো দেশের বুকজুড়ে ছাই ফেলে যাবে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment