মেরিলিন মনরো: রূপ আর রহস্যঘেরা চিরকালের কিংবদন্তি
আজ সর্বকালের অন্যতম সেরা লাস্যময়ী তারকা বলে খ্যাত মেরিলিন মনরোর ৯৯তম জন্মবার্ষিকী। রূপ, খ্যাতি আর আকর্ষণের প্রতীক হয়ে ওঠা মনরোকে ঘিরে গ্ল্যামারের যত মোহ, তার আড়ালেই লুকিয়ে ছিল এক ভাঙা শৈশব, হৃদয়ভাঙা প্রেম, বারবার ব্যর্থ বিয়ে আর নিজেকে প্রমাণ করার এক জেদি চেষ্টা। কিংবদন্তী এই অভিনেত্রীর জন্মদিনে তাঁর শৈশব থেকে মৃত্যু যাত্রা নিয়ে লিখছেন তুফায়েল আহমদ।
হলিউডের ঝলমলে আলো তাঁকে যতটা জাগিয়েছে, নিঃসঙ্গতার ছায়া ঠিক ততটাই গিলে খেয়েছে। মেরিলিন মনরো—যাঁকে ঘিরে আজও আলো ঝলকে ওঠে গ্ল্যামার আর মোহের। পর্দায় মনরোর উপস্থিতি মানেই ছিল দর্শকের হৃদয়হরণ আর উপচে পড়া ভিড়। তাঁর সময়ের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত এই অভিনেত্রী পরিচিত ছিলেন “ব্লন্ড বম্বশেল” নামে। কিন্তু কেবল রূপের ঝলকেই আলো ছড়াননি—মেধা, অনায়াস রসবোধ আর দীপ্ত বুদ্ধির মেলবন্ধনে পর্দার বাইরেও মনরো ছিলেন জীবন্ত এক গল্প। শুধু ‘সেক্স সিম্বল’ নন, মন ছুঁয়ে যাওয়া হাসি আর অনন্য ফ্যাশন সেন্সে ম্যারিলিন মনরো ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই কোটি হৃদয়ের স্টাইল আইকন।
শৈশব ও পরিচয়ের খোঁজে অবিরাম ছুটে চলা
মেরিলিন মনরোর জন্ম ১৯২৬ সালের ১ জুন, লস অ্যাঞ্জেলেসে। মা গ্ল্যাডিস পার্ল বেকার জন্মের পর তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘নর্মা জিন’। নর্মা জিনের জীবনে ‘বাবা’ শব্দটি ছিল এক দুঃস্বপ্নের শূন্যতা—চিরস্থায়ী অনুপস্থিতি। কখনো জানতেই পারেননি নিজের জন্মদাতা বাবার আসল পরিচয়। মায়ের মানসিক ভারসাম্যহীনতা সেই শূন্যতাকে আরও গভীর করে তোলে। এক ফস্টার হোম থেকে আরেক ফস্টার হোমে স্থানান্তর, কোথাও সাময়িক আশ্রয়, আবার কোথাও নির্যাতনের ছায়া।
বাবা নামক অজানা ছায়ার সঙ্গে, মানসিক ভারসাম্যহীন মা ও স্থিরতাবিহীন শৈশব—এই তিন ট্রমা তাঁর ভেতরে জন্ম দিয়েছিল গভীর অবিশ্বাস, অনিরাপত্তা আর তীব্র ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা। জীবনের প্রথম অধ্যায়ের এমন মানসিক ভূকম্পনের রেশ তিনি বয়ে বেড়িয়েছেন মৃত্যু পর্যন্ত।
মডেলিং থেকে রূপালি পর্দার যাত্রা
ভাঙা শৈশবের ধুলা মুছে নিজের জন্য একটা স্বপ্নের ছবি আঁকতে চেয়েছিলেন মনরো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৪৪ সাল) কারখানায় কাজ করার ফাঁকে এক আলোকচিত্রীর ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়া নীল চোখ, সোনালি চুল, আর অনাবিল হাসির মনরো খুব তাড়াতাড়িই হয়ে উঠলেন জনপ্রিয় পিন-আপ মডেল।
১৯৪৬ সালে ফক্স স্টুডিওর সঙ্গে প্রথম চুক্তি, আর সেখানেই জন্ম ‘মেরিলিন মনরো’ নামের এক নতুন পরিচয়। মনরো ধীরে ধীরে গড়ে তুললেন নিজের এক নতুন ছায়া—প্রতিটি ভঙ্গিমায় অনাবিল আকর্ষণ, আত্মবিশ্বাস আর দৃষ্টিতে অদম্য হাহাকার। ছোট চরিত্র দিয়ে শুরু হলেও, দর্শকের চোখ আটকে থাকত ঠিক তাঁর ওপরেই। ‘নিয়াগারা’, ‘জেন্টলমেন প্রেফার ব্লন্ডস’, ‘সেভেন ইয়ার ইচ’—একটার পর একটা ছবিতে নিজেকে ছাপিয়ে গিয়েছেন মনরো।
মনরো হয়ে উঠলেন সময়ের মুখ। বিস্ময়, শ্রদ্ধা আর কৌতূহলের মিশেলে উচ্চারিত হতে লাগলো তাঁর নাম । অথচ পর্দার উজ্জ্বলতায় আড়ালেই মনরো ছিলেন ক্লান্ত, বারবার নিজের শৈশব আর পরিচয়ের খুঁজে ছুটে চলা এক একলা সত্ত্বা।
প্রেম, বিয়ে এবং জন এফ কেনেডির সঙ্গে সম্পর্কের জনশ্রুতি
পৃথিবী যাঁকে চেয়েছে, তাঁর নিজের জীবন ছিল চাওয়া আর না-পাওয়ার চিরস্থায়ী দোলাচলে। ভালোবাসাকে তিনি বাঁধতে চেয়েছেন তিনবার—তিন বিয়েতে। কিন্তু প্রতিবারই সে বাঁধন ছিঁড়ে গেছে, ঠিক যেন কোনো আলগা গিঁট যা যত টানলে তত খুলে যায়।
প্রথম বিয়ে, মাত্র ১৬ বছর বয়সে—জেমস ডগার্টির সঙ্গে। অগুছালো জীবনের নিরাপত্তার খোঁজে এক চুপচাপ সিদ্ধান্ত। হয়তো প্রেম ছিল না, ছিল প্রয়োজন। এরপর এল খ্যাতির ছায়া আর তাঁর সঙ্গে জো ডি ম্যাজিও—বেসবলের কিংবদন্তি। তাঁর সঙ্গে এক তীব্র ভালোবাসার আকর্ষণ, আবার ততটাই বিস্ফোরক সংঘর্ষ। ম্যারিলিন চেয়েছিলেন শ্রদ্ধা আর সাহচর্য, কিন্তু সেই সম্পর্ক দিয়েছে শুধু অবজ্ঞা আর একাকীত্ব। তৃতীয় বিয়ে নাট্যকার আর্থার মিলারের সঙ্গে—ম্যারিলিন ভেবেছিলেন, অবশেষে তাঁকে বোঝার মতো একটা মানুষ পাওয়া গেল। কিন্তু সেই সম্পর্কের স্থায়িত্বও ছিলো মাত্র ৫ বছর।
এরই মধ্যে জন এফ. কেনেডির সঙ্গে সম্পর্কের ফিসফাস আর গুজব। একসঙ্গে দুজনকে দেখা গেছে খুব কম, কয়েকটা মাত্র ছবি, খুব অল্প প্রমাণ, কিন্তু রয়ে গেছে এক অনন্ত কৌতূহল, এক অমীমাংসিত রহস্য। সেই রহস্যকে আরও প্রাণবন্ত করেছে ১৯৬২ সালে মনরোর গাওয়া ‘হ্যাপি বার্থডে মিস্টার প্রেসিডেন্ট’।
নিঃসঙ্গতা আর অকাল প্রয়াণ
তবে মনরোর যতটা বাহ্যিক আভা, ভেতরে নিঃসঙ্গতা ছিলো ততটাই । তিন বিয়ে, ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক, মাতৃত্বের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা আর সাফল্যের চাপে মনরো ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন নিজের সত্তা থেকে। হতাশা আর অবসাদের গাঢ় ছায়া তাঁকে ঘিরে ধরে। ১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুর পরও থেকে যায় বহু প্রশ্ন, বহু কল্পনা, বহু রহস্য।
মেরিলিন মনরো শুধু জনপ্রিয় এক অভিনেত্রীই ছিলেন না। ছিলেন স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা এক চরিত্র। একদিকে লাস্যময়ী গ্ল্যামার, অন্যদিকে অন্তরালে ভাঙাচোরা এক মন। তাঁর জীবন যেন ছিল এক অন্তহীন প্রচেষ্টা—ভালোবাসা খোঁজার, স্বীকৃতি পাওয়ার এবং সবচেয়ে বড় কথা, নিজের অস্তিত্বের মূল্য বোঝানোর। তাই তো মৃত্যুর এত বছর পরেও, মেরিলিন মনরো সৌন্দর্য আর বেদনার অপূর্ব সংমিশ্রণ রূপালি পর্দার সেই চিরসবুজ প্রতিমা হয়ে রয়ে গেছেন।
মেরিলিন মনরোকে নিয়ে সিনেমা, উপন্যাস, প্রবন্ধ অনেক লেখা হয়েছে। প্রতিটি গল্প তাঁর জীবনের নিজস্ব সংস্করণ হয়ে উঠেছে। তবে একমাত্র জায়গা যেখানে তিনি ছিলেন নিজের মতো, তা হলো—তাঁর অভিনয়। তাঁর চলচ্চিত্রই আজ তাঁর সবচেয়ে বড় স্মারক। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু রয়ে গেছে সেই মায়া, সেই রহস্য, সেই স্থির চাহনি।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment