মেসবাড়িতে যেভাবে লড়াই করে বেঁচে থাকেন নারীরা
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে মেস ভাড়া করে থাকেন অসংখ্য শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী নারী। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পরিবার-পরিজন ছেড়ে এসে কেমনভাবে চলে তাঁদের দিনযাপনের লড়াই? সেই বিত্তান্ত মেলে ধরেছেন শতাব্দীকা ঊর্মি
শর্মির বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার পর খুলে গেল জীবনের এমন এক দরজা যার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে যেন এক অনন্ত অজানা প্রান্তর। যে মেয়েটি নিজের ঘর ছাড়া আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েও একরাত ঘুমোতে পারত না, তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকার জায়গা হিসাবে বেছে নিতে হলো ‘মেস’। গ্রামের সবুজ স্মৃতির মাঝে হঠাৎ ঢুকে যায় ভীষণ শব্দদূষণ আর জ্যামময় রাস্তা, আর ঘরে ফিরে দেখতে হয় কিছু অচেনা অজানা মানুষ। ছোট একটা ঘরে তিনজন মেয়ে, তিনটি টেবিল চেয়ার, তিনটি খাট হয়ে উঠল তার নতুন যাপনের অংশ।
প্রথম রাতেই অজানা ভয়, কারও ফোনে কথা বলার শব্দ, কারোর পড়ার শব্দ, কারও খুব মিশতে চাওয়া আর কারও একেবারেই না মিশতে চাওয়ার মতো কিছু অচেনা জটিল অনুভূতি নিয়ে কাটাতে হলো ক্লান্তিকর নির্ঘুম রাত।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে এই সব কিছু নিয়েই পুরান ঢাকার মেসের এই ঘরই হয়ে উঠল শর্মির একান্ত নিজের, স্বপ্ন সংগ্রামের আঁতুরঘর।
শর্মির মতো আরও অনেক নারীই জীবন জীবিকার উদ্দেশ্যে শহরে আসেন এবং থাকার জন্য বেছে নেন মেসগুলোকে। কেউ আসে পড়তে, কেউবা চাকরির কারণে, কেউ আবার সবকিছু ছেড়ে নিজের মতো করে নিজস্ব সংগ্রাম চালিয়ে নিতে। বিশেষত ঢাকা শহরে নারীদের আবাসন সংকটের মাত্রা প্রতিবছরই উর্ধ্বমুখী। রাজধানীর নীলক্ষেত, খিলগাঁও, বেইলি রোড ও মিরপুরের চারটি সরকারি হোস্টেল এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে যতগুলো আসন সংখ্যা তার তুলনায় ঢাকায় আসা কর্মজীবি নারী ও নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। তাই পরিবারের বাইরে নানান লক্ষ্যে শহরে আসা নারীদের আবাসন হিসেবে শেষ ঠিকানা হয়ে ওঠে ছোট ছোট ফ্ল্যাটগুলো, যেখানে একটি রুমে ৩/৪টি করে আসন তৈরি করে বানানো হয় মেস। আবাসন চাহিদা বেশি হওয়ায় ভাড়াও গুণতে হয় বেশি।
ঢাকার বাইরে অন্যান্য শহরের চিত্রও কাছাকাছি। সেখানে সবাইকেই যেতে হয় কিছু সাধারণ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে। যেমন, সকালবেলা বাথরুমের সিরিয়াল, ফ্রিজে খাবার রাখারা জায়গা না পাওয়া, বাসনপত্র রাখার জায়গা না পাওয়া, কাপড় মেলা নিয়ে ঝামেলা, ঘর পরিস্কার নিয়ে সময় ভাগের ভীষণ সিরিয়াস আলোচনা, কখনো অর্থসংকটে এক বা দুবেলা না খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া, জ্বর হলে মাকে কাছে না পাওয়া, কখনো রাতভর আড্ডা, একসঙ্গে গান গাওয়া ইত্যাদি। নানারকম অম্লমধুর অভিজ্ঞতা নিয়ে জীবনের এক বিশেষ এক জায়গা দখল রাখে মেসে কাটানো সময়, গড়ে ওঠে দায়িত্বশীলতা আর আত্মবিশ্বাস।
বাস্তবিক অর্থে মেসে যারা আসেন, তাদের বেশির ভাগই আসেন চ্যালেঞ্জিং বাস্তবতা থেকে অথবা সামনের চ্যালেঞ্জকে মুখোমুখি হওয়ার মানসে। এর মধ্যেই শুরু হয়ে যায় চিরাচরিত সমাজবাস্তবতার পরীক্ষা। যেহেতু শহরের বাইরে থাকা নারীদের বহিমুখীতাকে আমাদের শহুরে সমাজও খুব একটা সুদৃষ্টিতে দেখে না তাই সাধারণ জীবনসংগ্রাম নারীদের জন্য দ্বিগুণ চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে পুরুষের তুলনায়। বাড়িওয়ালার কাছে অহেতুক জবাবদিহিতা, মহল্লা বা এলাকার মানুষের নানারকম দৃষ্টি, মেসে ফেরার বা বের হওয়ার সময় নিয়ে অন্যের আগ্রহ, অনিরাপদবোধ—এসব কিছুর মধ্যে নিজেকে প্রমাণ করতে থাকা বাস্তবিক অর্থেই হয়ে ওঠে অগ্নিপরীক্ষা। শিখতে হয় নিজেকে নিজের রক্ষা করা এবং পাশের বান্ধবীটিকেও রক্ষা করার কৌশল।
এ এক এমন পরীক্ষা যার মধ্যে থেকে শেখা হয়ে ওঠে অর্থ ব্যবস্থাপনা, নিয়মানুবর্তিতা ও ধৈর্যের পাঠ। জীবন যেহেতু একটা বৈচিত্র্যের ভান্ডার, তাই মেসজীবনের নানা সংগ্রামের মধ্যে অর্জন হিসাবে যুক্ত নতুন সব বন্ধু ও সম্পর্ক। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী দেখা মেলে সহযাত্রীর, আবার কখনো কখনো ভুল বন্ধুর পাল্লায় পড়ে লক্ষ্যভ্রষ্টও হতে হয়।
এই বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার মেসজীবনের ভেতরেই শর্মীদের চোখে থাকে স্বপ্নের কিরণ। ছোট একটা অগোছালো ঘরেই মজবুত হতে থাকে পেশাজীবনের ভিত। এখান থেকেই কেউ পায় স্বপ্নের চাকরিটি, স্বপ্নের সিজিপিএ স্কোর, স্কলারশিপসহ নানারকম সাফল্যের সিঁড়ি। বাস্তবতা, অভিজ্ঞতার ভেতর থেকে তারা ছেঁকে তোলে আগামীকে। তাই মেসগুলো নারীদের কেবল থাকবার জায়গা নয়, হয়ে ওঠে স্বপ্ন ও আগামীর বীজতলা।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment