এআই কি তবে সব ‘মুশকিলের আসান’
এখনকার তরুণদের পছন্দের মধ্যে নানাভাবে খুব দ্রুতই জায়গা করে নিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। কেন এই প্রযুক্তি এত পছন্দ করছেন তরুণেরা? এটি কি এখন তবে সকল কাজের কাজী? জানাচ্ছেন মিনহাজ রহমান পিয়াস
দিনকয়েক আগে আমার বন্ধু মনিরকে দেখলাম লেন্সা নামের একটি কৃত্রিমবুদ্ধিমত্তা বা এআইভিত্তিক অ্যাপ নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। এআই দিয়ে প্রেমিকার ছবির পোট্রেট করার চেষ্টা করছিল সে। প্রতিবার ‘প্রম্পট’ করার পর নতুন নতুন করে ছবির সংস্করণ পাচ্ছিল। মজার বিষয় হলো, বেশির ভাগ ছবিই প্রায় আসলের মতোই মনে হচ্ছিল। ছবি-বিশারদ না হলে ধরাও মুশকিল যে সেগুলো আসলে এআই দিয়ে বানানো!
যাঁরা জানেন না তাদের জন্য বলি, প্রম্পট হলো এআইকে নির্দেশনা বা কমান্ড দেওয়ার আধুনিক নামকরণ। ২০২২ সালে প্রথমে ‘ওপেন এআই’ নামে একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মূলত ‘ডাল-ই’ নামের একটি অ্যাপ দিয়ে এ ধরনের ছবি তৈরি শুরু করেছিল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাজারে চলে এল আরও আধডজন কোম্পানি, যারা শুধু একটি লিখিত নির্দেশনা শুনেই সেই অনুযায়ী ছবি তৈরি করে দিতে পারে। ব্যাপারটা অনেকটা তেলেসমতি কারবারের মতো, তাই না? সাম্প্রতিক দুনিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এমন অনেক তেলেসমতি ঘটনাই ঘটিয়ে চলেছে।
বর্তমান প্রজন্মের তরুণেরা খুব দ্রুত কাজ করতে চান। ইউটিউবে থাকা পাঁচ মিনিটের ভিডিও ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে তিন মিনিটেই দেখে ফেলেন তাঁরা। সময় সবার কাছেই মোটামুটি কমে আসছে। এমন অস্থির সময়ে তাই তরুণদের পছন্দ হলো এআই। চোখের নিমেষে কাজ করে ফেলার অসাধারণ দক্ষতা ব্যবহার করে তরুণেরা এখন পড়াশোনা, পরীক্ষার অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি, ছবি ও ভিডিও বানানো, মিউজিক কম্পোজ থেকে শুরু করে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ, সবই করছে।

চ্যাটজিপিটির ব্যবহার করেনি কিংবা অন্তত নাম শোনেনি, এ সময়ে এমন একজন তরুণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এখনকার তরুণদের মধ্যে চ্যাটজিপিটি, ডিপসিক, মিডজার্নি, হ্যালাও, ইডিমেকার, ডিপফেক ব্যবহার করার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। কারণ এই তরুণদের একটি বড় অংশ এখন ঝুঁকছেন কন্টেন্ট নির্মাণের দিকে। আর স্বভাবতই এসব কাজ করতে গিয়ে তাঁরা সবচেয়ে বেশি নির্ভর করছেন এআইয়ের ওপর। যেমন আগেই বলা হলো, মিডজার্নি বা ডাল-ই দিয়ে তাঁরা ছবি বানাচ্ছেন। আবার ওই ছবিকে ভিডিওতে রূপও দিচ্ছেন। এখানেই শেষ নয়, এইআইকে প্রম্পট করে অনেকেই যেমন এখন পুরোদস্তর ভিডিও নির্মাণ করছেন, তেমনি ভয়েসওভার দেওয়া হচ্ছে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
এআই তবে কি সব মুশকিলের আসান? সকল কাজের কাজী?
উত্তর হলো, না। এখানেই আসে ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ’-এর প্রসঙ্গ। প্রযুক্তি সবসময় মানবকল্যাণের জন্য তৈরি হলেও একদল মানুষ এর ক্ষতিকর দিকটিও উন্মোচন করে এবং তাকে এ খাতে ব্যবহার করে। এআইয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, এমন একটি ছবি নিয়ে বছর দুয়েক আগে আলোড়ন উঠেছিল বেশ। অন্যদিকে সারা বিশ্বের অসংখ্য সেলিব্রেটির অশ্লীল সব ভিডিও মাঝেমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়, যার সবই ডিপফেক দিয়ে বানানো। অথচ এগুলো বানানো হয়েছিল প্রিয় চলচ্চিত্রের একটি ক্লিপে নায়ক বা নায়িকার জায়গায় নিজের চেহারা বসিয়ে নিষ্কলুষ বিনোদনের জন্য। সেই প্রযুক্তিই দিন শেষে ব্যবহৃত হয়েছে পর্নগ্রাফিতে, অন্য একজনের মুখাবয়ব বসিয়ে কুৎসিত বিনোদনের অংশ হিসেবে।
অন্যপক্ষে এক চ্যাটজিপিটি দিয়ে কোনো কিছু লিখিয়ে নেওয়ার সহজ প্রযুক্তি এখন ব্যবহার হচ্ছে শিক্ষার্থীদের হোমওয়ার্ক বা অ্যাসাইনমেন্ট লিখিয়ে নেওয়ার কাজে। ফলে পড়াশোনার ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থীই বেছে নিচ্ছেন ‘সহজ রাস্তা’। মোটা দাগে এগুলোকেই এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের কুফল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অনেকে।
তাই এআইয়ের বিভিন্ন প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে যেমন ‘সহজ’ করেছে, তেমনি আমাদের করেছে অনিরাপদও। লেখার শেষ বেলায় মাথার মধ্যে ‘ওল্ড স্কুল’ ব্যান্ডের একটা গানের লাইন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘তুই কে রে তুই সব সহজ শৈশবকে বদলে দিলি কিছু যান্ত্রিক বর্জ্যে’।
এখানে এই ‘তুই’ আসলে এআই। এআই আমাদের জীবনকে অনেক ক্ষেত্রে সহজ করে তুললেও মানুষের জীবনের সব স্তরে মুশকিল আসানের ভূমিকা এই প্রযুক্তির পক্ষে কখনোই নেওয়া সম্ভব নয়, ইতিহাসের নিরিখে কথাটি বেশ বড় গলায়ই বলা যায়।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment